গেমিং অ্যাপ ব্যবহার করে যেভাবে প্রধানমন্ত্রী বেছে নিল নেপালের জেন-জিরা

নেপালে টানা দুদিনের সহিংস বিক্ষোভে অন্তত ৭২ জন নিহত হওয়ার পর দেশজুড়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে এবং দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কেপি শর্মা অলির সরকারের পতন হয়। এ পরিস্থিতিতে নেপালের জেন-জিরা এক অভূতপূর্ব পথে হাঁটল—গেমারদের জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম ডিসকর্ডে অনলাইন ভোটের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী বেছে নেয় তারা।


রাজপথ থেকে অনলাইনে
আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন ‘হামি নেপাল’ তাদের ডিসকর্ড চ্যানেল ‘ইয়্যুথ এগেইনস্ট করাপশন’-এ ভোটের আয়োজন করে। দেড় লাখের বেশি সদস্যের এই চ্যানেলে ঘণ্টাব্যাপী উত্তপ্ত আলোচনায় উঠে আসে দুর্নীতি দমন, কর্মসংস্থান, বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার, স্বাস্থ্যসেবা ও পুলিশের জবাবদিহিসহ নানা ইস্যু।
অবশেষে ভোটের মাধ্যমে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করা হয়।
নেপালের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী
৭৩ বছর বয়সি সুশীলা কার্কি ১২ সেপ্টেম্বর শপথ নেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কারণেই তিনি জনপ্রিয়তা পান। বিচারপতি থাকাকালে ২০১২ সালে এক মন্ত্রীকে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে সরকার তার বিরুদ্ধে অভিশংসন আনার চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে সরকারের পছন্দের প্রার্থীকে পুলিশপ্রধান হিসেবে নিয়োগে অস্বীকৃতি জানানোই তার অভিশংসন প্রক্রিয়ার মূল কারণ ছিল।


শপথের পর তিনি ঘোষণা দেন, ‘আমরা ছয় মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকব না। দায়িত্ব শেষ করে নতুন সংসদ ও মন্ত্রীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করব।’
সরকারের পতন ও তরুণদের উত্থান
অলি সরকার ডিসকর্ড, টুইটার ও ইউটিউবসহ একাধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার পর তরুণরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাজপথে নামে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে তারা পার্লামেন্ট ভবনসহ সরকারি স্থাপনায় আগুন দেয়। এতে সরকারের পতন ঘটে এবং প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পডেল সংসদ ভেঙে দিয়ে মার্চে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
ডিসকর্ডে প্রার্থী বাছাই
প্রথমে পাঁচজন প্রার্থীকে সামনে আনা হয়—ধরানের মেয়র হরকা সাম্পাং, ন্যাশনাল ইনোভেশন সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর পুন, রাজনীতিবিদ সাগর ঢাকাল, আইনজীবী ও ইউটিউবার রাষ্ট্র বিমোচন তিমালসিনা এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি।


১০ হাজারের বেশি তরুণের আলোচনার পর সর্বাধিক সমর্থন পান কার্কি। কাঠমান্ডুর মেয়র ও জনপ্রিয় র্যাপার বালেন শাহের নামও প্রাথমিক তালিকায় ছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তিনি বাদ পড়েন। পরে তিনি প্রকাশ্যে কার্কিকে সমর্থন জানান। বিশ্লেষকদের মতে, আগামী নির্বাচনে তিনি শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন।
অনলাইন আলোচনার নতুন অভিজ্ঞতা
অংশগ্রহণকারীদের মতে, ডিসকর্ডের আলোচনা ছিল প্রচলিত রাজনীতির অন্ধকার ঘরোয়া সমঝোতার বিপরীতে এক স্বচ্ছ প্রক্রিয়া।
আইনের শিক্ষার্থী রেজিনা বসনেত বলেন, ‘সংসদ ভেঙে দেওয়া বা অন্তর্বর্তী সরকার মানে কী—এমন অনেক কিছুই আমরা জানতাম না। প্রশ্ন করেছি, বিশেষজ্ঞদের উত্তর শুনেছি এবং একসঙ্গে শেখার চেষ্টা করেছি।’
তবে ঝুঁকির কথাও বলেছেন বিশ্লেষকরা। সাংবাদিক প্রণয় রানা বলেন, ‘ডিসকর্ড অনেক বেশি সমতাভিত্তিক, কিন্তু ভুয়া অ্যাকাউন্ট বা ভুল তথ্যের মাধ্যমে ফলাফলে প্রভাব খাটানোর সুযোগ ছিল।’ এ কারণেই আয়োজকরা ‘ফ্যাক্টচেক’ নামের সাব-চ্যানেল চালু করেছিলেন।


সামনে কী
বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরও নেপালের রাজনৈতিক সংকট শেষ হয়নি। একদিকে তরুণদের ডিজিটাল নেতৃত্বের নতুন দিগন্ত, অন্যদিকে অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তির ছায়া রয়ে গেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল নেপালের সাবেক সভাপতি পদ্মিনী প্রধানাং বলেন, ‘আগের সরকারগুলো সততা, স্বচ্ছতা ও সুশাসনে ব্যর্থ হয়েছে। তরুণ প্রজন্মের উচিত এখন সেসব জায়গায় কাজ করা।’
নেপালের গণতন্ত্র তাই নতুন পরীক্ষার মুখে। আর সেই পরীক্ষার কেন্দ্রে রয়েছে তরুণ প্রজন্ম—যারা রাজপথের পাশাপাশি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তুলছে।


দৈনিক পুনরুত্থান /
- বিষয়:
- গেমিং
- অ্যাপ নেপাল
- জেন-জিরা
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আপনার মতামত লিখুন: