এসএসসির ফলে কড়াকড়ির ছাপ, গণিত-ইংরেজিতে বড় ধস!

# ১৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পাস
# ‘গ্রেস নম্বর’ ছাড়াই প্রকাশিত ফল
# ছাত্রীদের সাফল্য বেশি, ছেলেরা পিছিয়ে
# নকল কমলেও মানসম্মত পাঠদানে ঘাটতি
# মানবিক বিভাগে ফেল করা শিক্ষার্থীর হার বেশি


চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ‘প্রকৃত অবস্থা’ উন্মোচিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। যদিও আগের বছরের তুলনায় এবার পাসের হার কমেছে ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। একইসঙ্গে ১৬ বছরের মধ্যে এই ফলাফলই সবচেয়ে খারাপ। আর এমন অবস্থার পেছনে মূলত দায়ী ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে ভরাডুবি। বিশেষ করে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে এ দুই বিষয়ে এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী ফেল করায় বোর্ডটির পাসের হার গিয়ে ঠেকেছে সবচেয়ে নিচে—মাত্র ৫৬ দশমিক ৩৮ শতাংশে।
শিক্ষাবোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সব মিলিয়ে চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১৯ লাখ ২৮ হাজার ১৮১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন। গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত বছর যা ছিল ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ।
একইভাবে কমেছে সর্বোচ্চ গ্রেড প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন, গত বছর যা ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯। গতবারের তুলনায় কমেছে ৪৩ হাজার ৯৭ জন।
শিক্ষাবোর্ডগুলো বলছে, এ বছর ফলাফলে কোনো প্রকার ‘গ্রেস মার্ক’ বা বাড়তি নম্বর দেওয়া হয়নি। যা পাওয়া গেছে, তা-ই নম্বরপত্রে উঠে এসেছে। ফলে ফলাফলে সহানুভূতির প্রভাব পড়েনি। বরং খাতা মূল্যায়নে কড়াকড়ি, ভেন্যু কেন্দ্র বাতিল, কেন্দ্রে কেন্দ্রে নজরদারির জোরদার তদারকির প্রভাবেই প্রকৃত অবস্থা উঠে এসেছে।
অন্যদিকে আগের ফলের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ২০১১ সালে পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ১৬ শতাংশ, ২০১২ সালে ৮৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৮৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৯১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৮৭ দশমিক ০৪ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৮৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০১৭ সাল ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৭৭ দশমিক ৭৭ সাল, ২০১৯ সালে ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ, ২০২০ সালে ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ২০২১ সালে ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ (করোনার বছরে অটোপাস), ২০২২ সালে ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। সে অনুযায়ী বিগত বছরের তুলনায় এবার পাসের হার ঠেকেছে তলানিতে।


বরিশাল বোর্ডের ভয়াবহ পতন
বোর্ডভিত্তিক ফলাফলে দেখা গেছে, সবচেয়ে ভালো করেছে রাজশাহী বোর্ড—পাসের হার ৭৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এরপর যশোর ৭৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ, চট্টগ্রাম ৭২ দশমিক ০৭, আর ঢাকা ৬৭ দশমিক ৫১ শতাংশ।
তলানিতে অবস্থান বরিশাল বোর্ডের। শুধু ইংরেজি (পাসের হার ৬৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ) আর গণিত (৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ)—এই দুটি বিষয়ের ব্যর্থতাই বোর্ডটিকে নিচে নামিয়ে দিয়েছে।
বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ইউনুস আলী সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা কোনো পরীক্ষার্থীকেই বাড়তি নম্বর দিইনি। পরীক্ষার পরিবেশ ছিল স্বচ্ছ ও নকলমুক্ত। ফলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অবস্থাটাই ফুটে উঠেছে। পরীক্ষার প্রতিটি ধাপে আমরা যথাযথ নিয়ম মেনে চলেছি। জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল পর্যন্ত সবাই কঠোরভাবে কেন্দ্র তদারকি করেছে। আমি নিজেও বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি।
ইংরেজি-গণিতের ভরাডুবিতে ডুবেছে বরিশাল বোর্ড, কারণ কী?
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এবার স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল—শিক্ষার প্রকৃত মান যাচাই করতে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া যাবে না। সেই নির্দেশনা অনুসরণ করেই আমরা কঠোরভাবে পরীক্ষাটি পরিচালনা করেছি। ফলে এবার যে ফলাফল এসেছে, সেটিই শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অবস্থা প্রতিফলিত করেছে।


ছাত্রীদের অগ্রগতি, পেছনে ছেলেরা
পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৭৩৯ জন ছাত্রী আর ৯ লাখ ৬১ হাজার ২৩১ জন ছাত্রের মধ্যে ছাত্রীদেরই সাফল্য বেশি। ছাত্রীদের পাসের হার ৭০ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ছেলেদের ৬৫ দশমিক ১১ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭৩ হাজার ৬১৬ জন ছাত্রী, ছেলেদের চেয়ে ৮ হাজার ২০০ জন বেশি।
গ্রেস নম্বরের যুগ শেষ
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, শিক্ষার্থীরা খাতায় যা লিখেছে, সেটি অনুযায়ী নম্বর পেয়েছে। কেউ ৭৯ পেয়ে ৮০ পায়নি। আমরা চাই সত্যিকারের মেধার মূল্যায়ন হোক।
তিনি আরও বলেন, আগে যেভাবে নম্বর বাড়ানো হতো, সেই যুগ আর নেই। এখন ফলাফল হবে প্রকৃত অর্জনের ভিত্তিতে। চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় নকলসহ বিভিন্ন অসদুপায়ের অভিযোগে বহিষ্কৃত হয়েছে ৭২১ জন। ২০২০ সালে যেখানে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৫৫ জন। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বোর্ডে বহিষ্কারের হার সবচেয়ে কম।


ভোকেশনাল ও দাখিলেও পতন
দাখিল পরীক্ষায় পাসের হার ৬৮ দশমিক ০৯ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৭৯.৬৬ শতাংশ। ভোকেশনাল শাখায় পাসের হার ৭৩.৬৩ শতাংশ, গতবার যা ছিল ৮১.৩৮ শতাংশ। তবে জিপিএ-৫ এর দিক থেকে ভোকেশনালে কিছুটা অগ্রগতি দেখা গেছে—এবার ৪ হাজার ৯৪৮ জন, যা গতবার ছিল ৪ হাজার ৭৮ জন।
শিক্ষকের ঘাটতি ও যথাযথ দিকনির্দেশনার অভাবে ফল বিপর্যয়
শিক্ষা বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত সংকট—দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি, মানসম্পন্ন পাঠদানের অভাব এবং শিক্ষার্থীদের সঠিক দিকনির্দেশনা না পাওয়ার বিষয়টি এ বছর এসএসসি পরীক্ষার ফলে নতুন করে স্পষ্ট হয়েছে।
তাদের মতে, বিশেষ করে ইংরেজি ও গণিতের মতো মূল বিষয়ের ক্ষেত্রে এই ঘাটতি আরও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। তাই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, পাঠদানে নজরদারি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসম্পন্ন একাডেমিক পরিবেশ নিশ্চিত না করা হলে ভবিষ্যতেও এমন ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে।


সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে অনেক শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হতে না পারায় পাসের হার কমেছে। বিশেষ করে মানবিক বিভাগে ফেল করা শিক্ষার্থীর হার বেশি।
তিনি বলেন, দুর্গম হাওরাঞ্চল ও গ্রামের অনেক প্রতিষ্ঠানে মানসম্পন্ন গণিত ও ইংরেজি শিক্ষকের অভাব রয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী প্রবণতা, অমনযোগিতা এবং শিক্ষকদের সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবও খারাপ ফলাফলের অন্যতম কারণ।
তিনি আরও যোগ করেন, ফলাফল বিশ্লেষণের মাধ্যমে যেসব বিষয় দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ভবিষ্যতে পরিকল্পনা নেওয়া হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ, দুর্বল বিদ্যালয়ের প্রতি বাড়তি নজর এবং পাঠদানে মনিটরিং আরও জোরদার করার চেষ্টা করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এবং সাত কলেজের সাবেক সমন্বয়ক অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার বলেন, শিক্ষার মান যাচাইয়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় হলো স্বচ্ছ পরীক্ষা এবং নিরপেক্ষ মূল্যায়ন। তবে শুধু পরীক্ষা কড়াকড়ি করে ফল ভালো হবে না—তার আগে প্রয়োজন পাঠদানে গুণগত পরিবর্তন। দেশের বহু স্কুলে এখনো দক্ষ গণিত ও ইংরেজি শিক্ষকের সংকট রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের মৌলিক শিক্ষায় পিছিয়ে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আজ যেসব বিষয়ে ফেল করছে, সেগুলোর পেছনে শুধু তাদের অমনযোগিতা নয়—পাঠদানের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অভিভাবকদের উদাসীনতা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়হীনতা কাজ করছে। এসব দূর করতে হলে প্রথমেই শিক্ষকদের মানোন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে, নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে এবং মূল্যায়নে স্বচ্ছতা আনতে হবে। বেসরকারি স্কুল-কলেজে লক্ষাধিক শিক্ষকপদ শূন্য, এর দায় কার উপর বর্তাবে?


অধ্যাপক খোন্দকার আরও বলেন, পড়াশোনায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এখন সময় এসেছে কঠোর নজরদারি ও জবাবদিহির। বিদ্যালয়গুলোতে শুধু ক্লাস রুটিন থাকলেই হবে না, সেটি কতটা কার্যকর হচ্ছে, সেটি তদারক করতে হবে। উপজেলা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় প্রশাসন পর্যন্ত ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে ধীরে ধীরে শিক্ষার মানে অগ্রগতি আসবে।
তিনি মনে করেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত উন্নয়ন এবং অভ্যন্তরীণ দায়বদ্ধতা ছাড়া শুধু ফলাফলের পরিসংখ্যান দেখে পরিবর্তন আশা করা যাবে না। শিক্ষায় বেশি বরাদ্দ, মেধাবীদের শিক্ষায় আকৃষ্ট করার চেষ্টা থাকতে হবে। সবশেষ করোনা, নতুন শিক্ষাক্রম, শিক্ষক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা এসবের কারণেও শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দৈনিক পুনরুত্থান /
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আপনার মতামত লিখুন: