• ঢাকা
  • শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২

Advertise your products here

  1. জাতীয়

জিপিএ-৫ এ ধস : বাস্তব মূল্যায়ন নাকি শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্গতি?


দৈনিক পুনরুত্থান ; প্রকাশিত: শুক্রবার, ১১ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ০২:৫৩ পিএম
জিপিএ-৫ এ ধস : বাস্তব মূল্যায়ন নাকি শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্গতি?

২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় সারাদেশে একযোগে প্রকাশ করা হয়েছে। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিগত বছরের তুলনায় অপ্রত্যাশিতভাবে কমেছে।

দেশের সাধারণ নয়টি বোর্ড এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ড মিলে মোট ১৯ লাখ চার হাজার ৮৬ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসলেও জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র এক লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন। যা গত কয়েক বছরের গড় তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। জিপিএ-৫ বিপর্যয়ের পাশাপাশি দুর্গতির ছায়া পড়েছে গড় পাসের হিসাবেও।

গত ১৫ বছরের মধ্যে চলতি বছর এই পরীক্ষায় পাসের হার অনেক কমেছে। কেবল গত বছরের তুলনায় এ বছর ১৪.৫৯ শতাংশ কমেছে। সার্বিক ফলাফল কি শিক্ষা ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত দুর্বলতার ফল, নাকি এটি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা ও যোগ্যতার এক বাস্তবসম্মত প্রতিফলন— এমন প্রশ্ন এখন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

তবে, গড় পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের এই দুর্গতিকে কেউ দেখছেন বাস্তব মূল্যায়নের প্রতিফলন হিসেবে। কেউবা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শিক্ষার্থীদের দুর্বল প্রস্তুতির ফল বলে ব্যাখ্যা করছেন। কঠিন প্রশ্ন ও মূল্যায়নে অতি কড়াকড়ির প্রতিফলন এটি— এমনও মন্তব্য করছেন শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ।
ছাত্র-জনতার বিপ্লবের কারণে পরীক্ষার আগে প্রায় আট মাস পড়াশোনা একেবারেই ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞানে কঠিন প্রশ্ন ছিল বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। মূল্যায়নেও অন্যান্যবারের চেয়ে কড়াকড়ি ছিল। সবমিলিয়ে ধাক্কা লেগেছে পাসের হারে।

পাঁচ বছরে সর্বনিম্ন জিপিএ-৫

ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে সাধারণ নয়টি বোর্ডে মোট জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল এক লাখ ৬৩ হাজার ৮৪০ জন। ২০২২ সালে ৭১ হাজার ৬৫০ জন বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ৩৫ হাজার ৪৯০ জনে। ২০২৩ সালে এক লাখ ৫৯ হাজার ২২০ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়। তবে, গেল বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে সাধারণ নয় বোর্ডে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা আরও চার হাজার ৪৬৫ জন বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৬৩ হাজার ৮৪৫ জনে।

চলতি বছর জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমেছে উল্লেখ্যহারে। এ বছর সাধারণ নয়টি বোর্ডে মোট জিপিএ-৫ পায় এক লাখ ২৫ হাজার ১৮ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থী ৫৮ হাজার ২৩৮ জন এবং মেয়ে শিক্ষার্থী ৬৬ হাজার ৭৮০ জন। ফলে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় এ বছর জিপিএ-৫ কম পেয়েছে ৩৮ হাজার ৮২৭ শিক্ষার্থী। এছাড়া, গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে কম সংখ্যক জিপিএ-৫ পেয়েছে এ বছরে।

জিপিএ-৫ এ বেহাল দশা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডেও

এদিকে, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে ২০২১ সালে মোট জিপিএ-৫ পায় ১৪ হাজার ৩১৩ শিক্ষার্থী। ২০২২ সালে এই সংখ্যা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৫৭ জনে। ২০২৩ সালে মাত্র ছয় হাজার ২১৩ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেলেও ২০২৪ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ হাজার ২০৬ জনে। তবে, এ বছর জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা পাঁচ হাজার ১৪০ জন কমে দাঁড়িয়েছে নয় হাজার ৬৬ জনে।

জিপিএ-৫ : গতি ফেরেনি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডেও

ফলাফল বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, ২০২১ সালে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে মোট জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা ছিল ৫১৮৭ জন। ২০২২ সালে এ সংখ্যা তিন গুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৬৬৫ জনে। ২০২৩ সালেও কারিগরি বোর্ডের ১৮ হাজার ১৪৫ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়। তবে, ২০২৪ সালে এ সংখ্যা আবারও তিনগুণের অধিক কমে দাঁড়ায় মাত্র চার হাজার ৭৮ জনে। সবশেষ ২০২৫ সালে এ শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা দাঁড়ায় চার হাজার ৯৪৮ জনে। অর্থাৎ ২০২২ ও ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে উল্লেখ্যযোগ্যহারে জিপিএ-৫ পেলেও সবশেষ দুই বছর এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি কারিগরি শিক্ষা বোর্ড।

স্থগিত হলো কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বৃহস্পতিবারের পরীক্ষা

চলতি বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলের সঙ্গে গত চার বছরের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে সাধারণ নয়টি বোর্ড, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড মিলে মোট জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন। ২০২২ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জনে। ২০২৩ সালে সবগুলো বোর্ড মিলে মোট জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জনে। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জনে। সবশেষ ২০২৫ সালে সবগুলো বোর্ড মিলে জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জনে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে এবারই সর্বোচ্চ কম সংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে।

সর্বোচ্চ পাস বিজ্ঞানে, সর্বনিম্ন মানবিকে

চলতি বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, এ বছর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অংশ নেয় পাঁচ লাখ ৬০ হাজার ৫৯৫ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে পাস করেছে চার লাখ ৮০ হাজার ২৯৪ শিক্ষার্থী। শতকরা হিসাবে বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার ৮৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। অর্থাৎ বিজ্ঞান বিভাগেই সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছে। এদিকে, এবার মানবিক বিভাগে পাসের হার সর্বনিম্ন। এ বিভাগে চলতি বছর মোট ছয় লাখ ৬৭ হাজার ৭৬ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে পাস করেছে তিন লাখ ৫৯ হাজার ৩৮২ জন। শতকরা হিসাবে এ বিভাগে পাসের হার মাত্র ৫৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এছাড়া, চলতি বছর ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে দুই লাখ ৫১ হাজার ৬৩৯ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। পাস করেছে এক লাখ ৬৬ হাজার ৮৭৮ জন। শতকরা হিসাবে এ বিভাগে পাসের হার ৬৬.৩২ শতাংশ।

জিপিএ-৫ ধস নিয়ে যা বলছেন শিক্ষাবিদরা

এবার কেবল যোগ্যরাই জিপিএ-৫ পেয়েছে। এটা বাস্তব মূল্যায়ন বলে মন্তব্য করেছেন দেশের প্রবীণ শিক্ষাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইমেরিটাস অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী।

তিনি ঢাকা পোস্টের বলেন, ‘আমার মনে হয় এবার শুধু যোগ্য শিক্ষার্থীরাই জিপিএ-৫ পেয়েছে। প্রতি বছর দেড় থেকে দুই লাখ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেলে তা কখনো কখনো অতিরিক্তই মনে হয়। অবশ্য শিক্ষার্থীদের এই সময়টাতে উৎসাহ দেওয়ার প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সবাইকে পাঁচের মধ্যে পাঁচই দিতে হবে। এবার যে ফলাফল হয়েছে, সেটিকে আমি একটি বাস্তবভিত্তিক মূল্যায়ন বলেই মনে করি।’

‘২০২৪ সাল ছিল একটি অস্থির রাজনৈতিক সময়। সেই সময় শিক্ষার্থীরাও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে এক লাখ ২৫ হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাওয়াটা মোটেই নেতিবাচক নয়। আমি মনে করি, দ্যাট ইজ ফেয়ার। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও শিক্ষার্থীরা যে ফলাফল করেছে, তা যথেষ্ট ভালো এবং প্রশংসার যোগ্য।’

একটি পরীক্ষার ফলাফল নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে— উল্লেখ করে অধ্যাপক এ কে আজাদ বলেন, ‘এটি নির্ধারিত হয় শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি, সময় ব্যবস্থাপনা এবং তারা কতটা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেছে, তার ওপর। এ বছর একটি বড় রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে তারা গেছে। তাতে তারা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে— সেসব বিষয় অবশ্যই মূল্যায়নের সময় বিবেচনায় আসা উচিত।’

প্রভাব ফেলেছে কারিকুলাম পরিবর্তন ও রাজনৈতিক অস্থিরতা

সার্বিক ফলাফল বিশ্লেষণ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ ড. এম তারিক আহসান বলেন, ‘এ বছর জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো, গত বছর শিক্ষার্থীরা একটি বড় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। সেখানে তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এই সম্পৃক্ততার কারণে তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ এবং মানসিক স্থিতি ব্যাহত হয়েছে।’

‘পাশাপাশি, শিক্ষার্থীরা যখন নবম শ্রেণিতে পড়ছিল, তখন নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী পড়াশোনা শুরু করে। কিন্তু দশম শ্রেণিতে উঠে তারা আবার ২০১২ সালের পুরোনো কারিকুলামে ফিরে যায়। হঠাৎ এই পরিবর্তন শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। সবমিলিয়ে এ পরিস্থিতির প্রতিফলন দেখা গেছে পরীক্ষার ফলাফলে।’

তিনি আরও বলেন, এই সমস্যা থেকে উত্তরণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আরও মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। এখানেই আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বড় ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। যেকোনো দেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিবর্তনে শিক্ষার্থীরা যখন অংশগ্রহণ করে, তখন তাদের সেই পরিবেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে নেতৃত্বের উদ্যোগ জরুরি। এই উদ্যোগ নিতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে, রাষ্ট্রকেও। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।

ড. তারিক আহসানের মতে, ‘সার্বিকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় জিপিএ-৫ প্রাপ্তির যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমি প্রায়ই এই প্রতিযোগিতাকে নেতিবাচকভাবে দেখি। এই প্রবণতার কারণে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত জ্ঞানার্জনের মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে কেবল পরীক্ষার্থী হয়ে ওঠে, শিক্ষার্থী নয়।’

জিপিএ-৫ কমার মূল কারণ মানহীন শিক্ষা

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি’র (বিইউবিটি) সাবেক উপাচার্য ড. মোহাম্মদ ফৈয়াজ খান কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। দেশের এই প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ মনে করেন, গত বছর শিক্ষার্থীরা গণঅভ্যুত্থানে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত ছিল। ফলে তাদের পড়াশোনা কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। এটি অনস্বীকার্য। শুধু তা-ই নয়, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে শিক্ষকরাও যথাযথভাবে শিক্ষাদান করতে পারেননি। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েই কয়েক মাস ধরে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। এই পরিস্থিতিই মূলত জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার বড় কারণ।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা মুখস্তভিত্তিক শিক্ষার মধ্যে আটকে আছে। এজন্য শিক্ষকরাও দায়ী। তারা শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে মোটিভেট করতে পারছেন না। ফলে সৃজনশীল চিন্তাধারার যে বিকাশ প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে না।’

তিনি মনে করেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থার এই সংকট প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাথমিকের ভিত্তি যদি শক্ত না হয়, তাহলে এসএসসি বা এইচএসসিতে ভালো ফল করা সম্ভব নয়। আর ভালো ফলাফলের জন্য দরকার ভালো শিক্ষক। পাশাপাশি কীভাবে শিক্ষার্থীদের আরও কার্যকরভাবে পড়ানো যায়, সেই বিষয়েও গভীর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।’

হতাশার কিছু নেই, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনামুখী করাই জরুরি

জানতে চাইলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তবে, আমি বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে দেখছি না। শুধু জিপিএ-৫ কম পাওয়া মানেই যে শিক্ষার মান কমে গেছে, এমনটি বলা ঠিক নয়। এতে মন খারাপ করার কিছু নেই। তবে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত মান বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ফেরানো জরুরি। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এটা অবশ্যই উদ্বেগে, কিন্তু আমি আশাবাদী। তারা সামনে আরও ভালো করবে।’

দেশের এই খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ বলেন, এই ফলাফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাবিমুখতার একটি প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। তা-ই শুধু সরকার নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদেরও উচিত শিক্ষার্থীদের আবার স্কুলমুখী করে তোলা।

ওভার মার্কিং না থাকায় জিপিএ-৫ কমেছে

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক অনিন্দ্য ইকবাল বলেন, “এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ‘ওভার মার্কিং’ করার নির্দেশনা ছিল। ফলে ফলাফলের সামগ্রিক চিত্র বেশ উজ্জ্বল দেখানোর চেষ্টা করা হতো। শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে তাদের ফলাফল তুলনামূলক ভালো দেখানো হতো। কিন্তু এবারের পরীক্ষা ও মূল্যায়নে সে ধরনের ‘ওভার মার্কিং’ করা হয়নি। এবার নম্বরায়ন যথাযথ এবং সঠিকভাবে করা হয়েছে। তা-ই ফলাফল আগের তুলনায় কিছুটা কমে এসেছে। এটি একটি বড় কারণ।”

ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বর্তমান উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে এবারের ফলাফল এক প্রজন্মের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। এই শিক্ষার্থীরা কোভিডকালে অটোপাস পেয়েছে, নিয়মিত ক্লাস হয়নি, শিক্ষার ভিত্তি দুর্বল ছিল। এরপর নতুন কারিকুলাম নিয়ে এলোমেলো পরিস্থিতি, আর বছরের শেষ দিকে রাজনৈতিক অস্থিরতায় আট মাস কার্যত পড়াশোনা হয়নি। তার ওপর কঠিন প্রশ্ন আর মূল্যায়নে কড়াকড়ি। সবমিলিয়ে তারা একাধিক ধাক্কা খেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমে যাওয়া স্বাভাবিক এবং এটিই বাস্তব মূল্যায়ন।’

ফলাফলে জুলাই বিপ্লবের প্রভাব

এ বছর পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার কমে যাওয়ার বিষয়ে যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. আব্দুল মতিন বলেন, ‘গত বছরের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থাৎ জুলাই বিপ্লবের প্রভাব পড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক একাডেমিক কার্যক্রমে। অনেক প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাস নিতে সমস্যা হয়েছে। শিক্ষার্থীরাও হয়তো পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখতে পারেনি। তাছাড়া, এ বছর আমরা অত্যন্ত সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে পরীক্ষান আয়োজন করেছি। ফলে অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এই বিষয়গুলো ফলাফলে কিছুটা প্রভাব পড়েছে বলে আমার ধারণা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, যারা পরীক্ষক তাদের বিশেষ কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বা বেশি নম্বর দেওয়ার বিষয়ে আলাদা কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বরং বলা হয়েছে, যে যত নম্বর পাওয়ার যোগ্য তাকে যেন সেই নম্বরই দেওয়া হয়। এটা একটা কারণ। এছাড়া, জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী ট্রমার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা গিয়েছে। এটাও বড় কারণ হতে পারে।’

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শোয়াইব জিবরান বলেন, ‘করোনা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারেনি। এ কারণে জিপিএ-৫ কম হয়েছে। অন্যদিকে, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ মো. সিয়াম বলেন, ‘এ বছর জিপিএ-৫ ও পাশের হার হ্রাস পাওয়ার কারণ হিসেবে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ হ্রাস এবং প্রস্তুতির ঘাটতিই অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করছি। তবে, জিপিএ-৫ পাওয়াই বড় কথা নয়। বিশ্লেষণধর্মী দক্ষতা অর্জন এবং ভালো মানুষ হওয়াই জরুরি।’

দৈনিক পুনরুত্থান /

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন