ধার নিয়ে পুরোনো ঋণ পরিশোধ করছে সরকার

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় শুরু থেকেই তারা কৃচ্ছ সাধনের নীতি গ্রহণ করে। এর মধ্যেও সরকারের সার্বিক ঋণ বেড়েছে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বিদায়ি অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণ বেড়েছে ১৩ দশমিক ০৯ শতাংশ। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ঋণ বেড়েছিল ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
সরকার চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার আমলের পুরোনো ঋণ পরিশোধ করছে। পুরোনো ঋণের পরিমাণ ১২ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। এই সরকার ঋণ নিয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশ ব্যয় হয়েছে পুরোনো ঋণ পরিশোধে। এটা করতে গিয়ে একদিকে সরকারের ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে রাজস্ব আয় কম হওয়ায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টান পড়ছে।
সরকারের ধার বৃদ্ধির জন্য তিন কারণ শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-রাজস্ব আদায় কম ও ব্যয় বৃদ্ধি, গত সরকারের নেওয়া বেপরোয়া বকেয়া ঋণ পরিশোধের মাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে টাকার মান নিম্নমুখী হওয়া।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, বিদায়ি অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে নতুন ঋণ নেওয়া হয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা ও নন-ব্যাংক খাত থেকে ৪৪ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান সরকার দুই খাত মিলিয়ে ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। গত সরকার যখন বৈদেশিক ঋণ নিয়েছিল তখন ডলারের দাম ছিল ৮৫-৮৬ টাকা। এখন খোলাবাজার থেকে ১২২ টাকা করে ডলার কিনে পরিশোধ করতে হচ্ছে।


গত সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা চেপেছে বর্তমান সরকারের কাঁধে। এগুলো পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারকে চড়া সুদে ধার করতে হচ্ছে।
গত আওয়ামী লীগ সরকার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় ঋণ নিয়েছিল ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। ২০০৯ সালের জুনে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া ঋণের স্থিতি ছিল ৫৮ হাজার কোটি টাকা।
গত বছরের জুলাইয়ে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকায়। আলোচ্য সময়ে সরকারের ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। ২০০৯ সালের শুরুতে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ২ হাজার ২৭৯ কোটি ডলার। গত বছরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৮১ কোটি ডলারে।
এ সময়ে সরকারের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ২ কোটি ডলার। বর্তমানের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে স্থানীয় মুদ্রায় এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। সব মিলে সরকারের মোট ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা।


প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকার বাজার থেকে গড়ে ১২২ টাকা দরে কিনে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৬১ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নেওয়া হয়েছিল।
ডলার সংকটের কারণে ঋণের শর্ত অনুযায়ী যথাসময়ে পরিশোধ করতে পারেনি পতিত সরকার। ফলে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। এতে ঋণের বিপরীতে সুদের হারের পাশাপাশি দণ্ড সুদ আরোপের হারও বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার যখন এসব ঋণ গ্রহণ করে তখন ডলারের দাম ছিল ৮৫ থেকে ৮৬ টাকা। অথচ ১২২ টাকা দরে ডলার কিনে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। এতে প্রতি ডলারে বাড়তি পরিশোধ করতে হয়েছে ৩৬ থেকে ৩৭ টাকা। এছাড়া ঋণ নেওয়ার সময় সুদের হার ছিল ৫ থেকে ৬ শতাংশ।
পরিশোধের সময় ছিল ৯ থেকে ১০ শতাংশ। এর সঙ্গে ছিল দণ্ড সুদ। এসব ঋণের প্রায় সবই ছিল স্বল্পমেয়াদি। শর্তানুযায়ী বাজারে ডলারের দাম ও সুদহার পরিশোধের সময় যা থাকবে ওই হারেই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। যে কারণে ১০০ টাকা ঋণের জন্য পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ১৫০ টাকা। অর্থাৎ ডলারের দাম, সুদের বৃদ্ধি ও দণ্ড সুদ আরোপের কারণে প্রায় ৫০ শতাংশ অর্থ বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।
অথচ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বাড়তি পরিশোধ করতে হতো। এর মধ্যে সুদের হার ৫ থেকে ৬ শতাংশ ও মুদ্রার অবমূল্যায়নজনিত বাড়তি ব্যয় ৪ থেকে ৫ শতাংশ।
দুই অর্থবছর ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। এতে সরকারের আয় কমেছে। কিন্তু খরচ বেড়েছে। ফলে সরকারকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সংকুচিত করার পরও বাড়তি ঋণ নিতে হচ্ছে। আগে সরকার স্থানীয় উৎস থেকে ৪-৬ শতাংশ সুদে ঋণ নিত। এখন সুদের হার বেড়ে ৮-১২ শতাংশের উপরে উঠেছে।


দৈনিক পুনরুত্থান /
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আপনার মতামত লিখুন: