• ঢাকা
  • শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ৩০ কার্তিক ১৪৩২

Advertise your products here

  1. জাতীয়

সিডরের ভয়াল রাত: ১৮ বছরেও আতঙ্ক কাটেনি উপকূলবাসীর


দৈনিক পুনরুত্থান ; প্রকাশিত: শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ০৪:৪৩ পিএম
সিডরের ভয়াল রাত: ১৮ বছরেও আতঙ্ক কাটেনি উপকূলবাসীর

প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের দিন কাল। এই দিনটি উপকূলবাসীর কাছে এক বিভীষিকার নাম। ১৮ বছর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে তাণ্ডব চালায় দানবরূপী সিডর। লণ্ডভণ্ড করে দেয় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল।

সেই রাতের ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাগেরহাটের শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, মোংলাসহ উপকূলীয় অঞ্চল পরিণত হয়েছিল এক মৃত্যুপুরীতে।

ঘণ্টায় প্রায় ২৪০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়টি ধ্বংস করে দেয় উপকূলীয় বেড়িবাঁধ, ঘরবাড়ি, ফসল, গাছপালা, গবাদিপশু, অবকাঠামোসহ সবকিছু। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, উপকূলে প্রাণহানি হয়েছিল প্রায় তিন হাজার মানুষের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সুন্দরবনসংলগ্ন শরণখোলা উপজেলাটি।

শুধু এই এক উপজেলাতেই সরকারি হিসবে মারা গিয়েছিল সহস্রাধিক মানুষ। যা বেসরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি। সিডরের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় সুন্দরবনের বিশাল অংশ। মারা যায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ অসংখ্য বণ্যপ্রাণী।

শরণখোলা উপজেলার আওতাধীন সুন্দরবনের দুবলার চরে তখন চলছিল শুঁটকি উৎপাদনের ভরা মৌসুম। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা দুবলার চরের আলোরকোল, অফিসকিল্লা, মাঝেরকিল্লা, মেহেরআলী, নারকেলবাড়িয়া এবং শ্যালার চরে তখন অবস্থান করছিলেন ১০ হাজারেরও বেশি জেলে। ঝড়ের পূর্বাভাষ পেয়ে অনেকেই আগে নিজ নিজ এলাকায় চলে গেলেও অনেক জেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবস্থান করছিলেন চরেই। যারা সেদিন বাড়ি না ফিরে চরেই থেকে গিয়েছিলেন, তাদের বেশিরভাগ জেলেরই সন্ধান মেলেনি। সেদিন শুঁটকি পল্লীর কত জেলে নিখোঁজ হয়েছিলেন, তার সঠিক সংখ্যাও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

তবে সিডরের জলোচ্ছ্বাসে শুঁটকি উৎপাদনকারী পাঁচটি চরে নিখোঁজ জেলের সংখ্যা দেড় থেকে দুই হাজার। পরবর্তী সময়ে বন বিভাগ, দুবলার ফিশারমেন গ্রুপ এবং বেঁচে ফেরা জেলেদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা যায়। সেদিন রাতের সেই বিভীষিকা আজও তাড়া করে ফেরে উপকূলবাসীকে।

 

১৮ বছর পার হলেও বিশেষ করে শরণখোলায় এখনো চোখে পড়ে সিডরের দগদগে ক্ষতচিহ্ন। টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় সেদিন নাজুক বাঁধ ভেঙে বলেশ্বর নদের জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল এই জনপদ। সিডরের ৯ বছর পর বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারে নির্মাণ করা হয় ৬২ কিলোমিটার উঁচু বেড়িবাঁধ। এর মধ্যে বলেশ্বর নদের তীরে শরণখোলার সাউথখালী ইউনিয়নের বগী থেকে মোরেলগঞ্জ উপজেলা সীমানার ফাসিয়াতলা পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নির্মিত বাঁধের পরিমাণ প্রায় ২০ কিলোমিটার। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি-১) মাধ্যমে ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি শুরু হয় এই বাঁধ নির্মাণের কাজ। ‘সিএইচডব্লিউই’ নামের চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এই কাজ বাস্তবায়ন করে। তিন বছরে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নানা অজুহাতে প্রকল্পটি শেষ হতে সময় লাগে প্রায় সাত বছর। কাজ শেষে ২০২৩ সালে ১৪ ডিসেম্বর বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে বাঁধটি হস্তান্তর করে ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু হস্তান্তরের দুই বছর যেতে না যেতেই বাঁধটি ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে। বলেশ্বর নদের তীর রক্ষাবাঁধের ২০ কিলোমিটারের বেশিরভাগ এলাকাতেই ভয়াবহ ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। অন্তত ১১টি স্থানের সিসি ব্লক ধসে মূল বাঁধেই ভাঙন দেখা দিয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই ও নির্মাণে ত্রুটি এবং নদী শাসন না করে নির্মাণের ফলে বাঁধটি এখন চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। বাঁধের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে আতঙ্কিত শরণখোলার বলেশ্বর পারের মানুষ। ভাঙনের ভযাবহতা দেখে তাদের মনে জেগে ওঠে সিডরের সেই ভয়ঙ্কর রাতের দুর্বিসহ স্মৃতি।

সিডরে স্বজন ও সহায়সম্বল হারানো সাউথখালী ইউনিয়নের বলেশ্বর পারের বগী গ্রামের সোলায়মান খাঁন, মোজাম্মেল খলিফা, উত্তর সাউথখালী গ্রামের মালেকা বেগম, দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান, গাবতলা গ্রামর শাহ আলমসহ অনেকেই বলেন, ‘প্রতিবছর নভেম্বর মাস এলেই আমাগো সিডরের সেই কাল রাইতের কথা মনে পড়ে। সেইদিন যদি একটা উঁচু এবং টেকসই বেড়িবাঁধ থাকত তাইলে আমাগো এত ক্ষতি হইতো না। তয় সবকিছু হারানোর পর উঁচু বাঁধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই বাঁধ টেকসই হয়নি। নদী শাসন না করে বাঁধ তৈরির করায় বলেশ্বর নদের ঢেউয়ে প্রতিনিয়ত তা ভেঙে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।’ বাঁধের অবস্থা দেখে এখনো তাদের মনে সিডর-আতঙ্ক বিরাজ করছে।

উপকূলের জানমাল এবং বাঁধ রক্ষায় রক্ষায় দ্রুত নদী শাসনের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন সাউথখালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. শহিদল ইসলাম লিটন।

শরণখোলা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘নদী শাসন ছাড়া টেকসই বাঁধ হওয়া সম্ভব নয়। তৎকালীন সরকার ও বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাঁধ নির্মাণে নদী শাসনের ব্যাবস্থা না রেখে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এখানে। মাটির বদলে নদীর বালু ব্যবহার করা হয়েছে। এতে শুধু বাঁধ উঁচুই হয়েছে, কিন্তু টেকসই হয়নি। দ্রুত নদী শাসন না করলে এই বাঁধ রক্ষা করা অসম্ভব।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘অধিক ঝূঁকিপূর্ণ প্রায় এক হাজার মিটার এলাকার ভাঙনরোধে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে শরণখোলার বগী এলাকার প্রায় ৭০০ মিটারে বালুভর্তি জিও ব্যাগ এবং সিসি ব্লক ও মোরেলগঞ্জ সীমানার ফাসিয়াতলা এলাকায় বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হবে।’

স্থানীয় নদী শাসনের বিষযে জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘স্থায়ীভাবে বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে প্রায় ৩০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে প্রকল্পের কাজ শুরু হতে পারে।’

দৈনিক পুনরুত্থান /

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন