১০ বছরে সীমান্তে ঝরেছে ৩০৪ প্রাণ, অপহরণ ২০৯

গত ৯ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের মাছিমপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে নিহত হন সাইদুল ইসলাম নামের এক বাংলাদেশি। এ ঘটনায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বিএসএফ কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানায় বিজিবি।


গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় বিএসএফের গুলিতে আল আমিন নামে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হন। ৬ মাস আগে বিয়ের পিড়িতে বসা আল আমিন সীমান্তের কাছে গরু আনতে গেলে গুলিবিদ্ধ হন। গত ১৬ এপ্রিল লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন বাংলাদেশি যুবক হাসিবুল আলম। সীমান্তের ৮৯৪ নম্বর মেইন পিলারের সাব পিলার ছয় এস-এর কাছে হাসিবুল গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর বিএসএফ সদস্যরা তাকে ভারতে নিয়ে যায়। এর ৩৬ ঘণ্টা পর বিজিবির কাছে হাসিবুলের মরদেহ হস্তান্তর করে বিএসএফ।
শুধু সাইদুল ইসলাম, আল আমিন কিংবা হাসিবুলই নয়– মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছরে শুধু সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে এবং নির্মম শারীরিক নির্যাতনের পর প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩০৪ জন বাংলাদেশি। গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ৩১৬ জন। এ ছাড়া অপহরণের শিকার হয়েছেন অন্তত ২০৯ জন বাংলাদেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি এবং ‘বর্ডার ভায়োলেন্স’ নিয়ে শক্ত অবস্থান না থাকায় সীমান্ত নিয়ে পৃথক আইন থাকার পরও এসব অপ্রয়োজনীয় হত্যাকাণ্ড একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ ও ভারতের দায়িত্বশীল আচরণ ছাড়া এ সমস্যা সমাধানের বিকল্প নেই।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালে বিএসএফের গুলিতে অন্তত ৪৬ জন বাংলাদেশি নিহত হয়। আহত হয় অন্তত ৭৩ জন এবং অপহরণের শিকার হয় ৫৯ জন বাংলাদেশি। ২০১৬ সালে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় অন্তত ৩১ বাংলাদেশি। আহত হয় অন্তত ৩৯ জন এবং অপহরণের শিকার হয় ২৪ জন বাংলাদেশি। ২০১৭ সালে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় ২৪ জন বাংলাদেশি। আহত হয় ৩৫ জন এবং অপহরণের শিকার হয় ৪০ জন বাংলাদেশি। ২০১৮ সালে বিএসএফের গুলিতে নিহতের সংখ্যা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১৪ জনে। ওই বছর ভয়াবহ অত্যাচারের পর মৃত্যু হয় অন্তত ৬ বাংলাদেশির। আহত হয় ১৫ জন এবং অপহরণের শিকার হয় ১৩ জন বাংলাদেশি।
২০১৯ সালে এ হত্যাকাণ্ড প্রায় তিনগুণ বেড়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৩ জনে। এদের মধ্যে অন্তত ৬ জনকে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। ওই বছর আহত হয়েছে অন্তত ৪৮ জন এবং ৩৪ জন অপহরণের শিকার হয়। ২০২০ সালে বিএসএফের গুলিতে নিহতের সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ জনে। ওই বছর আহত হয় ২৬ জন এবং অপহরণের শিকার হয় অন্তত ২২ জন।
২০২১ সালে সীমান্তে হত্যা কিছুটা কমে নেমে আসে ১৭ জনে। ওই বছর ৯ জন আহত এবং ৩ জন অপহরণের শিকার হয়। ২০২২ সালে সীমান্ত হত্যায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ জনে এবং আহত হয় ১৫ জন। এ ছাড়া ১১ জন অপহরণের শিকার হয়। ২০২৩ সালে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় ২৮ বাংলাদেশি এবং আহত হয় ৩১ জন। ২০২৪ সালে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় অন্তত ৩০ বাংলাদেশি। এদের মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর মারা যায় ৪ জন। এ ছাড়া ওই বছর আহত হয় অন্তত ২৫ জন বাংলাদেশি এবং অপহরণের শিকার হয় ৩ জন।


সীমান্ত হত্যা নিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দিন বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন সীমান্তকে ‘মৃত্যু-নির্ভর’ এলাকা থেকে ‘মানুষ-বান্ধব’ নিরাপত্তা বলয়ে রূপান্তর করা। এটা করতে হলে অবশ্যই দুই দেশের সদিচ্ছা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অপ্রয়োজনীয় সীমান্ত হত্যা বন্ধে জোরালো অবস্থানের পাশাপাশি ভারতেরও সদিচ্ছা জরুরি। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে পাশাপাশি অবস্থানে থাকা দুটি দেশের এমন হত্যাকাণ্ড অপ্রত্যাশিত ও অমানবিক। অবশ্যই সীমান্তের প্রতিটি হত্যা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতাও বটে। এটি কেবল মানবিক সংকট নয়, বরং অবশ্যই একটি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব।
এ বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন আসকের সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর আবু আহম্মেদ ফয়জুল কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, সীমান্তে এ ধরনের মৃত্যু বা হত্যাকাণ্ড অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডেরই তদন্ত হওয়া উচিত। কী কারণে একজন নাগরিককে গুলি করে হত্যা করা হলো এটা অন্য সাধারণ নাগরিকেরও জানার অধিকার রয়েছে। যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে তারা আসলে কী ধরনের পরিস্থিতিতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, এটা জানা জরুরি। ভারতের সঙ্গে আমাদের শত বছরের সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের নাগরিকরা যদি ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে বা চেষ্টা করে, সেটার জন্য আইন রয়েছে। একই আইন বাংলাদেশেও আছে। সাধারণভাবে বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের এমন অনুপ্রবেশের ঘটনা পেলে আমরা চাই তাদের আইন অনুযায়ী আটক করা হোক। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হোক। কিন্তু সেটা না করে এভাবে সরাসরি মরণাস্ত্র ব্যবহার করাটা আমরা চাই না। এটা অবশ্যই মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো একটি বিষয়।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সরকার মুহাম্মদ শামসুদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশিরভাগ সীমান্ত হত্যা বিশেষ করে বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্তে গরু পাচারের সঙ্গে সম্পর্কিত। গরু পাচারকারীরা অবৈধভাবে গরু পাচারের জন্য এলাকার অভাবী লোকদের টাকার বিনিময়ে রাখাল হিসেবে ব্যবহার করে। একটা গরুর জন্য ন্যূনতম একজন লোকের প্রয়োজন হয়, কখনো কখনো দুইজনও লাগে। তারা কাঁটাতার কেটে সীমান্ত অতিক্রম করে এবং আত্মরক্ষার জন্য স্থানীয়ভাবে তৈরি ধারালো ছুরি ও অন্যান্য সরঞ্জাম বহন করে। তারা কখনো কখনো দলে অনেক বড় হয়। যদিও পাচারকারীরা বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বিজিবি ও বিএসএফ) ঘুষ দিয়ে সহানুভূতিশীল করার চেষ্টা করে, অনেক সময় এতে কাজ হয় না। কারণ তারা অন্য বিএসএফ টহল টিম বা কর্তব্যরত অফিসারদের হাতে ধরা পড়ে যায় এমন একটা সময়ে যখন তারা সীমান্ত অতিক্রম করছে বা পাচার করা গরু নিয়ে ফিরছে। তখনই পাচারকারীরা আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র ব্যবহার করে আর বিএসএফ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। যার ফলে কখনো কখনো পাচারকারীদের মধ্যে কেউ কেউ নিহত ও আহত হয়। গরু পাচার রাতের অন্ধকারে নদীপথেও হয়। গরু পাচারকারীদের ভাড়া করা রাখালরা গরুসহ নদীতে ভেসে সীমান্ত-নদী পার হয়। বিএসএফ টহল এরকম ঘটনা প্রত্যক্ষ করলে তারা গুলি বর্ষণ করে। সুতরাং অবৈধভাবে গরু পাচার পুরোপুরি বন্ধ করতে পারলে সীমান্ত হত্যা অনেকাংশেই কমে যাবে।
অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপারের জন্য কাঁটাতার কাটা সীমান্ত হত্যার আরেকটি বড় কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএসএফ কর্মকর্তারা এ ধরনের ঘটনায় কঠোর মনোভাব নেন এবং সংশ্লিষ্ট টহল বা সীমান্ত পোস্টের সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে অনেক সময় বিএসএফ সদস্যরা অতিরিক্ত তৎপর হয়ে কাঁটাতার কাটতে দেখা মাত্রই গুলি চালায়। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য সীমান্তে বিজিবির সর্বোচ্চ নজরদারি দরকার।
এ নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, আমাদের সীমান্ত অনেকটাই উন্মুক্ত। সীমান্ত চৌকির জনবল ও সীমান্ত চৌকির সংখ্যা সার্বক্ষণিক টহল ও নজরদারির জন্য পর্যাপ্ত নয়। ফলে অনেক সময় সীমান্তের কিছু অংশ নজরদারির বাইরে থেকে যায়। এজন্য বিজিবির জনবল বাড়ানো জরুরি, যা সীমান্ত হত্যা রোধে সহায়ক হবে।


সরকার মুহাম্মদ শামসুদ্দিন বলেন, অনেক সময় বিএসএফ গুলি চালানোর ক্ষেত্রে সংযম বজায় রাখে না। কিছু বিএসএফ সদস্য ‘ট্রিগার হ্যাপি’, যারা গুলি চালিয়ে আনন্দ পায়। এজন্য বিএসএফকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও সংযম আরোপ করতে হবে। এটা সম্ভব হবে যদি বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সর্বদা ভালো রাখা যায় এবং ভারত সরকারও সীমান্ত হত্যা রোধে আন্তরিক হয়।
পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বিজিবিকে সীমান্তে নজরদারি ও গোয়েন্দা সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে অবৈধ সীমান্ত কার্যকলাপ ও পাচারকারীদের সঙ্গে সীমান্তরক্ষীদের অবৈধ লেনদেন সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন করা যায়। এতে কাঁটাতারের বেড়া কাটা, গরু পাচার ও অবৈধ পারাপার বন্ধ করা সহজ হবে।
সীমান্ত হত্যা নদী সীমান্ত এলাকায়ও ঘটে। কোথাও কোথাও সীমান্ত অচিহ্নিত নদীপ্রবাহ বরাবর চলে গেছে। জেলেরা কখনো কখনো নৌকায় করে মাছ ধরতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে ফেলেন। এসময় বিএসএফের টহল টিম তাদের ওপর গুলি চালায়, যা অত্যন্ত অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য। অথচ উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী চাইলে তাদের সতর্ক করতে পারে, তাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু গুলি চালানোর কোনো ন্যায্যতা নেই, যোগ করেন এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
দৈনিক পুনরুত্থান /
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আপনার মতামত লিখুন: