পাঁচ দেশে কাগুজে রপ্তানির খেলা, ২২ কোটি টাকার কারসাজি!
চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানির কোনো পণ্য প্রবেশ করেনি, জাহাজেও কোনো পণ্য লোড করা হয়নি। অথচ আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি হয়ে গেছে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য! রপ্তানিকারকের ব্যাংক হিসাবে এসে গেছে ১৮ কোটি টাকাও। আবার রপ্তানি বাবদ সরকারের নগদ প্রণোদনা হিসেবেও উত্তোলন করা হয়েছে ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এমন অসম্ভব ঘটনা ঘটিয়েছে ডিওই (দো) এমপেক্স লিমিটেড নামে একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।
কাগজে-কলমে রপ্তানি দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা জালিয়াতি করার এ ঘটনার রহস্য উন্মোচন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের অনুসন্ধান বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ডিওই এমপেক্স লিমিটেড মোট ৪১টি বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল করে সরকারের প্রণোদনা গ্রহণ করে। যার মধ্যে ৭টি বিল অব এক্সপোর্টের বিপরীতে শাকসবজি, ফলমূল ও প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্যের চালান দুবাই ও অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর সত্যতা পাওয়া গেলেও ৩৪টি বিল অব এক্সপোর্টের বিপরীতে কোনো পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়নি।
অথচ পণ্য রপ্তানির বিপরীতে অগ্রিম হিসেবে পুরো অর্থ ২২ লাখ ১৮ হাজার ১৭.৪৪ মার্কিন ডলার অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রত্যাবাসন হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১৮ কোটি ৬০ লাখ ৯১ হাজার ৪০৪ টাকা। রপ্তানি দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ৩ কোটি ৭১ লাখ ৮১ হাজার টাকার সরকারি নগদ প্রণোদনাও উত্তোলন করেছে।
দুদক বলছে, এখানে মানিলন্ডারিং ও জাল-জালিয়াতির মতো দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে। যার সঙ্গে দো এমপেক্স লিমিটেডের মালিক ও কর্মকর্তা, সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট, কাস্টমস কর্মকর্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তাসহ মোট ২৬ জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে দুদক।
দুদকের অনুসন্ধানের অগ্রগতি জানতে চাইলে সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রপ্তানির নামে নগদ প্রণোদনা হাতিয়ে নেওয়ার নজির আগেও দেখেছি। দুদকে চলমান অনুসন্ধানে যাদের বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যাবে, কমিশনের অনুমোদনক্রমে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন
শেখ পরিবারের দুর্নীতির সুনামি, দুদকের ডজনখানেক মামলা
সেচ প্রকল্পে ২৪৮ কোটি টাকার নয়ছয়, ১৯ কর্মকর্তাকে তলব
তিনি শিক্ষার সহকারী সচিব, শুধু ব্যাংকেই লেনদেন ১৭ কোটি!
কী বলছে অনুসন্ধান
কাস্টমস বিভাগ ও দুদকে আসা রেকর্ডপত্র যাচাই-বাছাই শেষে দেখা গেছে, সরকার দেশের রপ্তানি খাতকে গতিশীল করতে নানা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কিন্তু দো এমপেক্স লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি প্রণোদনার সুযোগ নিয়ে ভুয়া চালান তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি আরব আমিরাত ও অস্ট্রেলিয়ায় ৭টি বিল অব এক্সপোর্টের বিপরীতে কৃষি জাতীয় পণ্য যথাযথভাবে রপ্তানি করলেও ৩৪টি বিল অব এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে বড় ধরনের জালিয়াতি করেছে। বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল করে আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডা ও সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে কৃষিপণ্য পাঠানো হয়েছে বলে কাগজে-কলমে রপ্তানি দেখায় তারা। তবে বাস্তবতা হলো, তাদের কোনো পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়নি এবং বন্দর হয়ে কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি।
অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তিনটি অস্তিত্বহীন শিপিং এজেন্ট ব্যবহার করেছে। যার মধ্যে রয়েছে ওসেন ফ্রাইট সিস্টেম লিমিটেড, গ্রিনভিউ ফ্রাইট সিস্টেম লিমিটেড এবং এভারেস্ট গ্লোবাল লজিস্টিক। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই এবং তারা কোনো পণ্য সরবরাহ করেনি। অথচ জাল বিল অব এক্সপোর্ট তৈরি করে তা ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে অগ্রণী ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট অডিট ফার্ম যথাযথ যাচাই না করে প্রণোদনার অর্থ ছাড় করেছে। তারা রপ্তানিকারকের উৎপাদন ক্ষমতা বা কারখানা পরিদর্শনও করেনি। ফলে ব্যাংক এবং অডিট ফার্মের ঘাটতি ব্যবহার করে রপ্তানিকারক কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করতে সক্ষম হয়েছে।
অনুসন্ধান বলছে, দো এমপেক্স লিমিটেড তাদের পাঁচটি সিএন্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে ভুয়া তথ্য এন্ট্রি করে। এক্ষেত্রে সুকৌশলে চট্টগ্রামের কাস্টমস দপ্তরের রাজস্ব কর্মকর্তা ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাদের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড এবং তাদের স্বাক্ষর ও সিল ব্যবহার করা হয়েছে। বিল অব লেডিং ও মূল্য প্রত্যাবাসন সার্টিফিকেট (পিআরসি) ইস্যু করা এবং পরবর্তীতে ১১ জন রাজস্ব কর্মকর্তার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে পুরো শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে কাগজে কলমে। কাগজে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও বাস্তবে কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি। এছাড়া পিআরসি এবং বিল অব লেডিং বা বিএল ইস্যু করার নিয়মও অমান্য করা হয়েছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা সঠিক যাচাই না করেই প্রতিষ্ঠানকে পিআরসি (প্রোসিড রিয়ালাইজেশন সার্টিফিকেট) জারি করেছেন বলে অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে।
ফলে ৩৪টি ভুয়া রপ্তানি চালানের বিপরীতে প্রাপ্ত ২২ লাখ ১৮ হাজার ১৮ মার্কিন ডলার বা ১৮ কোটি ৬০ লাখ ৯১ হাজার ৪০৪ টাকা মানিলন্ডারিং প্রক্রিয়ায় দেশে এসেছে। যা দেখিয়ে দো এমপেক্স লিমিটেড সরকারি রপ্তানি প্রণোদনা বাবদ ৩ কোটি ৭১ লাখ ৮১ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছে। অর্থাৎ রপ্তানি হয়নি, অথচ কোটি টাকার নগদ সহায়তা তুলে নেওয়ার অকাট্য প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
আরও পড়ুন
৩৬৪ পে-অর্ডারে ২৮৮ কোটি টাকা লোপাটের ছক ইকবাল সিন্ডিকেটের
নানকের পিএস তিনি; যোগ্যতা ৮ম শ্রেণি, সম্পদ হাজার কোটি!
তেল চুরির টাকায় ‘ব্রাজিল বাড়ি’র পাশে ডুপ্লেক্স বাড়িও করেন যমুনার জয়নাল
যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে
রপ্তানির নামে এ জালিয়াতিতে রপ্তানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্ট, অডিট প্রতিষ্ঠান, কাস্টমস ও ব্যাংক কর্মকর্তাসহ মোট ২৬ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. আহসান উদ্দিন। যাদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ কমিশন থেকে অনুমোদন করা হয়েছে।
অর্থাৎ এ ঘটনায় দুদকের মামলায় ফাঁসতে যাচ্ছে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান দো এমপেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. জিয়া হায়দার মিঠু ও এমডি আলোক সেনগুপ্ত, প্রতিষ্ঠানটির সিএন্ডএফ এজেন্ট কেএইচএল এক্সাম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম রাসেল, জি আর ট্রেডিং করপোরেশন সি অ্যান্ড লিমিটেডের পরিচালক বেগম রাসিদা পারভীন রুনু, অ্যাম এন্ড জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. আলতাফ হোসেন ও মো. আব্দুল জলিল আকন, প্যান বেঙ্গল এজেন্সিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সেলিম এবং সিএন্ডএফ এজেন্ট এ কে এন্টারপ্রাইজের মালিক আবুল কাসেম খান।
অন্যদিকে অডিট প্রতিষ্ঠানের কর্তা হিসেবে আসামি হতে যাচ্ছেন এ কাসেম অ্যান্ড কো চার্টার্ড একাউন্টসের মালিক মোহাম্মদ মোতালেব হোসেন ও জিয়াউর রহমান জিয়া, এমএবিএস অ্যান্ড জে পার্টনারের মালিক জগদীশ চন্দ্র বিশ্বাস, মুহাম্মদ সাজিদুল হক তালুকদার, নাসির উদ্দিন আহমেদ।
এ ছাড়া এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর কবির ও মবিন উল ইসলাম, সাবেক সহকারী কমিশনান মো. জয়নাল আবেদীন, রাজস্ব কর্মকর্তা জমির হোসেন, রাজস্ব কর্মকর্তা এ এইচ এম নজরুল ইসলাম, আমির হোসেন সরকার, গৌরাঙ্গ চন্দ্র চৌধুরী, ফরিদ উদ্দিন সরকার ও মো. মঞ্জুরুল হক এবং সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আব্দুস সাত্তার ও বাসুদেব পালকেও দায়ী করা হয়েছে অনুসন্ধানে।
অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার (এক্সপোর্ট) মো. রফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আনোয়ার জাহানও এতে আসামি হতে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
দৈনিক পুনরুত্থান /
- বিষয়:
- কারসাজি
- চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানি
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন
আপনার মতামত লিখুন: