• ঢাকা
  • সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

Advertise your products here

  1. জাতীয়

টিকটকের গুজবে চাপা পড়ল বাবা-মায়ের কান্না


দৈনিক পুনরুত্থান ; প্রকাশিত: সোমবার, ০১ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ০৬:১৬ পিএম
টিকটকের গুজবে চাপা পড়ল বাবা-মায়ের কান্না

ঢাকার যাত্রাবাড়ীর আকাশ সেদিন কিছুটা মেঘলা ছিল কি না, তা এখন আর কারো মনে নেই। তবে গত ৭ নভেম্বর বিকেলে ফারুক গাজী ও তার স্ত্রী লিপির জীবনে যে অন্ধকার নেমে আসে, তা কোনো অমাবস্যার চেয়ে কম নয়। শ্রমজীবী এই দম্পতি তাদের সন্তানদের নিয়ে একটু ভালো থাকার আশায় ছয় মাস আগে মৃধাপাড়ার মোল্লাবাড়ি এলাকায় একটি দোতলা ভবনে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। বাবা লোহার কারখানার শ্রমিক, মা বাসার সামনে পিঠা বিক্রি করেন- স্বপ্ন ছিল সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করবেন।

কিন্তু এক নিমেষেই সব শেষ হয়ে যায়। ১১ হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুতের তারে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় তাদের ১৩ বছরের আদরের মেয়ে খাদিজা। একই ঘটনায় দগ্ধ হয় আরেক কিশোরী খাদিজার বান্ধবী মরিয়মও (১৩)। আগুনের লেলিহান শিখায় দগ্ধ হয়ে ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে হেরে যায় মরিয়ম।

দুটি তরতাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ার এই ঘটনাটি হয়তো শুধুই বাবা-মায়ের দু:স্বপ্ন আর অপমৃত্যুর ফাইলে বন্দি হয়ে থাকত। কিন্তু বাস্তবতা এর চেয়েও নিষ্ঠুর। সন্তান হারানোর দগদগে ক্ষতে নুনের ছিটা হয়ে বিঁধেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি গুজব- ‘টিকটক’।

গুজবের ক্ষত ও মানবিক বিপর্যয়

সন্তানের পোড়া লাশের গন্ধে যখন বাতাস ভারী, তখন ফেসবুকে ভাইরাল হলো একটি ভিডিও। আগুনের লেলিহান শিখায় দুই কিশোরী পুড়েছে আর ভিডিওর ক্যাপশনে কেউ একজন লিখে দিল- “ছাদে টিকটক করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে দুই কিশোরীর মৃত্যু।”

অল্প কয়েকদিনের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল এই মিথ্যা। হাজার হাজার শেয়ার, লাখ লাখ ভিউ। আর কমেন্ট বক্সে উপচে পড়ল ঘৃণা, বিদ্বেষ আর উপহাস। কেউ লিখলেন, “উচিত শিক্ষা হয়েছে”, কেউবা দিলেন বদদোয়া। অথচ তারা জানলেন না, পর্দার ওপারে সত্যটা কতটা করুণ।

মানুষ তো সত্যটা জানে না। নিজের চোখের সামনে কোনো বাবা-মাই সন্তানের এত কষ্টের মৃত্যু সহ্য করতে পারে না। তাদের সেই ট্রমাই কাটেনি। আর এর মধ্যে আমরা দেখি ফেসবুকে কে বা কারা ভিডিওটা ছড়িয়ে দিয়েছে মিথ্যা ক্যাপশন দিয়ে। সেসব পোস্টের কমেন্ট সেকশনে আজেবাজে গালি, বদদোয়া আরও কত সব খারাপ কথা লিখছে মানুষ। মানুষ কি জানে আসলে কি হয়েছিল? নাকি জানার চেষ্টা করেছে। আমরা এখনো মৃত্যু শোকই কাটায়ে উঠতে পারিনি তার আগেই মানুষকে ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে। 
নিহত খাদিজার মামাতো বোন কেয়া
অসহায় দুই বাবা-মায়ের শোকের সময়টুকুও কেড়ে নিল এই সাইবার গুজব। সন্তান হারানোর বেদনার চেয়েও এখন তাদের বড় যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজের মানুষের বাঁকা কথার জবাব দেওয়া। আত্মীয়-স্বজনরা জানাজায় এসে সান্ত্বনা দেওয়ার বদলে জানতে চাইছেন, ‘মেয়েরা কি সত্যিই ভিডিও বানাচ্ছিল?’


টিকটকের গুজবে চাপা পড়ে যায় সত্য, কমেন্ট বক্সে উপচে পড়ে ঘৃণা
সেদিন বিকেলে আসলে যা ঘটেছিল

যাত্রাবাড়ীর মৃধাপাড়ার মোল্লাবাড়ি এলাকার তন্ময় খানের ভবনের দোতলায় বসবাস করে খাদিজা ও মরিয়মের পরিবার। খাদিজা শেখদী আব্দুল্লাহ মোল্লা সরকারি স্কুলের ছাত্রী ছিল। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ৭ম শ্রেণিতে ওঠার কথা ছিল তার। 

আরেক কিশোরী মরিয়মের বাবা আল আমিন গুলিস্তানে একটি জুতার দোকানে কাজ করেন। তার মা হামিদা বেগম গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে মরিয়ম ছিল সবার বড়। সে মাতুয়াইল আদর্শ সরকারি স্কুলে পড়তো। মেজো ভাই মারুফের বয়স ৭, আর ছোট ভাই হামিমের বয়স মাত্র ২ বছর। 

গোসলের পর ও আমার কাছে ফোনটা চাইছিল, আমি দেই নাই। একটু পর নিচে আইসা বলে, ‘আম্মু, ট্যাংকি দিয়া পানি পড়তাসে, আমি বন্ধ কইরা দেই?’ আমি না করছিলাম। কিন্তু ও মরিয়মরে নিয়া উপরে যায় পানি বন্ধ করতে। বাড়ির মালিকের অসচেতনতায় পানির ট্যাংকিতে কোনো অটো-স্টপ ব্যবস্থা ছিল না। ট্যাংক ভরে গেলে পানি উপচে পড়ত, আর সেই পানি বন্ধ করতে পাইপ ঘুরিয়ে দিতে হতো। 
নিহত খাদিজার মা লিপি বেগম
৭ নভেম্বর বিকেলে ওই ভবনের দোতলায় ছাদের এক কোণায় থাকা পানির ট্যাংকির পাইপ বন্ধ করতে ছাদে যায় খাদিজা ও মরিয়ম। ওই ভবনের পাশে মাত্র দেড় থেকে দুই ফুট দূরত্বে রয়েছে উচ্চ ভল্টেজের এইচটি লাইনের খোলা তার। যেই তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আগুনে পুড়ে অকালে প্রাণ হারায় দুই কিশোরী।    

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, পরিবার এবং স্থানীয়দের বয়ানে উঠে এসেছে সেই বিকেলের প্রকৃত চিত্র। খাদিজার বাবা ফারুক গাজী তখন মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। মা লিপি বাসার নিচে পিঠার দোকান সামলাচ্ছিলেন। খাদিজা বিকেলের দিকে গোসল সারে। তার দীর্ঘ ভেজা চুল। গোসল শেষে মা ও ভাইয়ের কাজে সাহায্য করে সে। মায়ের পিঠার দোকানের হাড়ি-পাতিল নামিয়ে দিয়ে আসে।

লিপি বেগম অশ্রুভেজা চোখে বলেন, গোসলের পর ও আমার কাছে ফোনটা চাইছিল, আমি দেই নাই। একটু পর নিচে আইসা বলে, ‘আম্মু, ট্যাংকি দিয়া পানি পড়তাসে, আমি বন্ধ কইরা দেই?’ আমি না করছিলাম। কিন্তু ও মরিয়মরে নিয়া উপরে যায় পানি বন্ধ করতে। বাড়ির মালিকের অসচেতনতায় পানির ট্যাংকিতে কোনো অটো-স্টপ ব্যবস্থা ছিল না। ট্যাংক ভরে গেলে পানি উপচে পড়ত, আর সেই পানি বন্ধ করতে পাইপ ঘুরিয়ে দিতে হতো। 

তিনি বলেন, ‘এর কিছুক্ষণ পরে একডা শব্দ হইল। দৌড়াইয়া গিয়া দেখি ছাদের অপর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতেছে। আমার মেয়ে ঝুলতাসে আর পুড়তাসে। আমার কলিজাটা পুইড়া যাইতাছিল। আমি মা হইয়া কিছু করতে পারলাম না। কেউ গিয়া ধরল না। একটা বাঁশ দিয়া একটু ঠেলা দিলেও পইরা যাইতো, কিন্তু কেউ গেল না, আমারেও যাইতে দিল না। আমি এখন কারে নিয়া বাঁচমু? ঘরে এখনও ওর বই-গাইড পইরা আছে। এগুলা দেখলে বুক ফাইটা যায়।’

লিপি বলেন, আমার ফোনে টিকটক করা যাইতো না। ওই ফোন আমি কখনই ওরে দিতাম না। মাঝে মাঝে সাজুগুজু কইরা ছবি তুলতো-এইটুকুই। কিন্তু ঘটনার দিন আমার টাচ ফোন আর বাটন ফোন দুইটাই চুরি হইয়া গেছে। ওই ফোনে আমার খাদিজার ছবি আছিল। এখন আমার কাছে কোনো স্মৃতিও নাই মেয়ের।


সেই তারে এখনো ঝুলছে ‍নিহত খাদিজার চুল
ঘটনার পর থেকে সবাই এটা ওটা বলতেছে। আমার কাছে জিজ্ঞেস করতেছে। আমি তো এত ভিডিও বুঝি না। কিন্তু মেয়েটা আমার টিকটক করতে যেয়ে দুর্ঘটনা ঘটেনি। আমার মনে হয় বাড়িওয়ালার কোনো আত্মীয় এসব মিথ্যা কথা ছড়াইছে। মেয়েটা এমনিতেই আমার খুব কষ্ট পেয়ে মরিছে আর কষ্ট না পাক।


নিহত খাদিজার বাবা ফারুক গাজী
নিহত খাদিজার বাবা ফারুক গাজী বলেন, আমি গিয়েছিলাম মাছ মারতে। খাদিজা বিকেল ৪টার দিকে গোসল করে ভেজা চুলে ছাদে উঠছিল। অনেক বড় চুল ছিল আমার মেয়ের। ওর মা বাড়ির সামনে পিঠা বিক্রি করছিল। এক ফাঁকে আমার মেয়ে পাশের বাড়ির ভাড়াটের মেয়ে মরিয়মের সঙ্গে ছাদে পানির ট্যাংকির পাইপ ঘুরিয়ে দিতে যায়। ট্যাংকিটা ছাদের কোণায় ছিল। ওরা মনে হয় ছাদের কোণায় বসেছিল এমন সময় পাশের বিদ্যুৎ লাইনের তারের সঙ্গে মেয়ের ভেজা চুল আটকে যায়। ঘটনার সময় মোবাইল ওর কাছে ছিলই না। মোবাইল ঘরে ছিল। দুর্ঘটনার পর কেউ একজন আমার হাতে ফোনটা দিয়েছিলও, কিন্তু পরে দৌড়াদৌড়ির সময় ফোনটা যে কার কাছে দিলাম আর মনে করতে পারিনি। ফোনটা পরে আর পাইনি। তাই থানায় ফোনটার জন্য একটা জিডিও করেছি। 

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া গুজব নিয়ে তিনি বলেন, ঘটনার পর থেকে সবাই এটা ওটা বলতেছে। আমার কাছে জিজ্ঞেস করতেছে। আমি তো এত ভিডিও বুঝি না। কিন্তু মেয়েটা আমার টিকটক করতে যেয়ে দুর্ঘটনা ঘটেনি। আমার মনে হয় বাড়িওয়ালার কোনো আত্মীয় এসব মিথ্যা কথা ছড়াইছে। মেয়েটা এমনিতেই আমার খুব কষ্ট পেয়ে মরিছে আর কষ্ট না পাক।

নিহত খাদিজার আপন মামাতো বোন জান্নাতুল ফেরদৌস কেয়া ফোন কলে বলেন, আমরা যশোরে থাকি। শুক্রবার বড় মামার মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে আমার পরিবারের সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে রাতে পৌঁছাই। এত দুঃখজনক একটা ঘটনা, আমরা এতদিনেও ভুলতে পারিনি। কিন্তু ফেসবুকে এত বাজেভাবে মিথ্যাটা ছড়াইছে যে সবাই দেখার পর খুব আফসোস করতেছি। মানুষ না জেনে, না শুনে ভিউ কামানোর জন্য উল্টোপাল্টা ক্যাপশন দিয়ে ভিডিও ছেড়ে দেয়। বাসাটার চারপাশেই কারেন্টের তারে ঘেরা। ভবন মালিক কিভাবে এত অসেচেতন হয় বুঝি না। পানির ট্যাংকিটা ভরে গেলে পাইপ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। পাইপ ঘুরিয়ে না দিলে পানি পড়ে ভেসে যায়, তাই ওরা সেটা বন্ধ করতে ছাদে গেছিল।  সবাই যে বলতেছে টিকটক করতেছিল, কিন্তু ওর কাছে ওই দিন ফোনই ছিল না। মরিয়ম মেয়েটার কাছেও ফোন ছিল না। কিন্তু সবাই ভিডিও পেয়েই লিখে দিল ‘টিকটক করতে গিয়ে মৃত্যু।’ মেয়েটা আমার মামার খুব আদরের ছিল।

তিনি আরও বলেন, মানুষ তো সত্যটা জানে না। নিজের চোখের সামনে কোনো বাবা-মাই সন্তানের এত কষ্টের মৃত্যু সহ্য করতে পারে না। তাদের সেই ট্রমাই কাটেনি। আর এর মধ্যে আমরা দেখি ফেসবুকে কে বা কারা ভিডিওটা ছড়িয়ে দিয়েছে মিথ্যা ক্যাপশন দিয়ে। সেসব পোস্টের কমেন্ট সেকশনে আজেবাজে গালি, বদদোয়া আরও কত সব খারাপ কথা লিখছে মানুষ। মানুষ কি জানে আসলে কি হয়েছিল? নাকি জানার চেষ্টা করেছে। আমরা এখনো মৃত্যু শোকই কাটায়ে উঠতে পারিনি তার আগেই মানুষকে ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে। 

ঘটনার সময় পাশের ঘরের সালমা বেগম রান্নাঘরে দুধ জ্বাল দিচ্ছিলেন। গুজব নিয়ে তিনি বলেন, ‘ওদের কোনো সময় দেহি নাই টিকটক করতে। কিন্তু এ কথা কে ছড়াইলো আল্লাহ জানে। মেয়েগুলা অনেক ভালো ছিল। ওরা স্কুল থাইকা আইসা আবার পড়তে যাইতো। বাসায় আইসাও পড়তো।’

ঘটনাস্থলেই খাদিজা নিহত হয়। পরদিন স্থানীয় কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের বাবা ফারুক গাজী যাত্রাবাড়ী থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলাও করেন। তবে একই ঘটনায় দগ্ধ মরিয়মকে ভর্তি করা হয় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। 

সেখানকার সহকারী অধ্যাপক মৃদুল কান্তি সরকার বলেন, ৭ নভেম্বর বিদ্যুতের হাই ভোল্টেজ শকে দগ্ধ হয়ে মরিয়ম প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি হয়। তার শরীরের প্রায় ৪০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে মাথা, ঘাড় ও পা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল।

তিনি আরও বলেন, মেয়েটির অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ডান পায়ের উরুর একটি অংশ অপারেশনের মাধ্যমে কেটে ফেলতে হয়। পরে পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে নিতে হয়। সেখানে সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। গত ১৬ নভেম্বর মরিয়মের মৃত্যু হয়।

নিহত মরিয়মের বাবা আল-আমিন বলেন, ঘটনার দিন আমি ঘরেই শুয়ে ছিলাম। আমার মেয়ে ঘরে মসলা বাটছিল। সে কখন ছাদে উঠে গেছে আমি বুঝতেই পারিনি। কিছুক্ষণ পর একটি বিকট শব্দ শুনে বাইরে বের হই। দেখি হাই ভোল্টেজ তারের ওপর খাদিজা পড়ে আছে, তার শরীর পুড়ছে। তখনও জানতাম না আমার মেয়ে মরিয়মও ছাদে ছিল। নিচ থেকে ছাদে কে আছে তা বোঝা যাচ্ছিল না। পরে আশপাশের মানুষ ডাকাডাকি করলে বুঝতে পারি আমার মেয়েও সেখানে পড়ে আছে।

‘উপরে গিয়ে দেখি খাদিজার পা আমার মেয়ের গায়ের সঙ্গে লেগে আছে। আমি মেয়েকে ধরতে গেলে আশপাশের মানুষ আমাকে বাধা দেয়, কারণ তখনও তারে কারেন্ট ছিল। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় মরিয়মকে নিচে নামিয়ে দ্রুত জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাই। ১০ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর আমার মেয়ে মারা যায়।’


নিহত মরিয়মের ফুফু সালমা আক্তার বলেন, আমরা পাশের গলিতেই থাকি। ঘটনার দিন আমি মায়ের সঙ্গে ছিলাম। দোতলা ছাদ থেকে খাদিজা মরিয়মকে ডেকে বলেছিল, ‘তোর ভাই মারুফ ট্যাংকির পানি ছাইড়া দিসে।’ তখন মরিয়ম ওকে বলে, ‘তুই পানি ছাইড়া আমার ভাইয়ের দোষ দিতাছস।’

‘এরপর মরিয়ম ওপরে গিয়ে পানি বন্ধ করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারছিল না। তখন খাদিজা বলে, ‘আমারে দে, আমি চেষ্টা কইরা দেখি।’ সে গিয়ে পানি বন্ধও করে। তারপর খাদিজা সেখানে বসে ছিল। তখন মরিয়ম খাদিজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পর খাদিজা মরিয়মকে পাশের হাই ভোল্টের তার দেখিয়ে বলে, ‘তারটা আমি ধরি?’ মরিয়ম তাকে বলে, ‘তার ধরিস না, এটা কারেন্টের তার।’ কিন্তু খাদিজা বলে, ‘এটা কারেন্টের তার না। কারেন্টের তার হইলে তো কসটেপ পেঁচানো থাকতো।’ এ কথা বলতে বলতে সে তার ধরার আগেই কেমনে যেন বিদ্যুৎ তাকে টেনে নেয়। মরিয়ম দৌড়ে যাওয়ার আগেই খাদিজা তাকে ধরে ফেলে।’

তিনি বলেন, ‘মরিয়ম মারা যাওয়ার আগে আমাকে এগুলো বলেছিল। টিকটকের বিষয়টা আশপাশের মানুষ ভাইরাল করার জন্য ছড়াইছে। মানুষ না বুঝে এমন একটা কথা কিভাবে ছড়ায় আমার মাথায় ধরে না।’

এই দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মা মেডিসিন ফার্মেসির দোকানদার কাদের কিবরিয়া বলেন, ‘সেদিন আমি আসরের নামাজ পড়ে দোকানে বসেছিলাম। দোকান থেকে ঘটনাস্থল স্পষ্ট দেখা যায়। দেখি মেয়েগুলো ছাদের ওপর দৌড়াদৌড়ি করে খেলাধুলা করছে। একপর্যায়ে তারা পানির ট্যাংকির আশপাশে খেলছিল বলে মনে হলো। এরপর আর খেয়াল করিনি। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ একটি বিকট শব্দ শুনি। তাকিয়ে দেখি একটি মেয়ে তারের ওপর পড়ে গেছে এবং তার শরীর আগুনে পুড়ছে। আরেকটি মেয়ে তাকে টান দিয়ে ধরেছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেসময় আশপাশের সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখেছে, অনেকে ভিডিও করেছে। কিন্তু কেউ সাহস করে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি। কিছুক্ষণ পর তারের ওপর ঝুলে থাকা মেয়েটি দোতলা থেকে নিচে পড়ে যায়।’

মেয়েরা টিকটক করছিল কি না- এমন প্রশ্নে কাদের কিবরিয়া বলেন, ‘আমি তাদের হাতে কোনো মোবাইল দেখিনি। কখনোই দেখিনি তারা টিকটক করে। মানুষের মৃত্যু নিয়ে এমন গুজব ছড়ানো খুবই অনুচিত।’


মামলার বিবরণী
সতর্কতার অভাব না নজরদারির ঘাটতি—কার অবহেলায় ঝরল দুই প্রাণ?

ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা যায়, মোল্লাবাড়ি এলাকার ওই ভবনের ছাদটি যেন মৃত্যুফাঁদ। ছাদের চারপাশে কোনো রেলিং নেই। পাশ দিয়ে যাওয়া উচ্চ ভোল্টেজের তার।

বাড়ির মালিক তন্ময় শাহরিয়ার খান জানান, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়িটি তিনি গত বছর ৫ আগস্টের পর বুঝে পেয়েছেন। এর আগে রাজনৈতিক নেতার দখলে ছিল। তিনি বলেন, আমি আসলে এই বাড়িতে ঘর ভাড়া দেওয়ার পক্ষেও ছিলাম না। আমার চাচাতো ভাই হুমায়ুনই ভাড়ার বিষয়গুলো দেখাশোনা করে।

বিদ্যুৎ অফিসে অভিযোগ করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমি মৌখিকভাবে বিদ্যুৎ অফিসে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারা বলেছে, লাইন সরানো সম্ভব নয়। আর সরাতে হলেও প্রায় ৮ লাখ টাকা খরচ লাগবে। তাই আর আগাতে পারিনি।

বাড়ির ছাদে রেলিং না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়ির দখল পাওয়ার পর এখনো এসব কাজ করার সুযোগ হয়নি। আমি ভাড়াটিয়াদের বলেছিলাম যেন কেউ ছাদে না ওঠে। কিন্তু এরপরও কেউ উঠলে আমার আর কী করার আছে?

কাজলা ডিপিডিসির প্রধান প্রকৌশলী রাশেদ ইসলাম বলেন, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, শিশুদের অসচেতনভাবে হাই ভোল্টেজ লাইনের খুব কাছে যাওয়ার কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। উচ্চ ভোল্টেজের কারণে এইচটি লাইনের তারে কাভারিং থাকে না। আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। আমাদের নিয়মিত পরিদর্শনে লাইনের উচ্চতা ও নিরাপত্তা মান বজায় রাখা হয়। স্থানীয়ভাবে কেউ যদি আগে কোনো অভিযোগ দিয়ে থাকেন, সেটিও আমরা খতিয়ে দেখছি। এ ধরনের দুর্ঘটনা যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে সেজন্য আমরা প্রয়োজনীয় সব প্রযুক্তিগত ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। একই সঙ্গে অভিভাবক ও স্থানীয়দের সচেতন থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি।

ডেমরা ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন মাস্টার মোহাম্মদ আলী বলেন, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমাদের একটি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় একটি শিশু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিহত হয়েছে। আমরা তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করি। আরেক শিশুকে আমরা পৌঁছানোর আগেই স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। হাই ভোল্টেজ তারের খুব কাছাকাছি যাওয়ায় এ ঘটনা ঘটে বলে ধারণা করছি।

যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, ঘটনার পর আমরা প্রাথমিক তদন্ত করেছি। পরিবার থেকে মামলা করতে না চাওয়ায় ঘটনাটিকে আমরা ইউডি (অপমৃত্যু) মামলায় অন্তর্ভুক্ত করেছি।

দৈনিক পুনরুত্থান /

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন