রাজধানীর ঘুম ভাঙলো ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে
আবারও সাত সকালে ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা।
বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) সোয়া ৬টার দিকে বিভিন্ন স্থানে এই ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা জানান, ৪.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এটি হালকা ভূমিকম্প। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদী জেলার শিবপুর।
তবে ভূমিকম্পের তথ্য প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউরোপিয়ান মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টার (ইএমএসসি) তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, ভূমিকম্পের গভীরতা ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৭ কিলোমিটার, এই ভূমিকম্পের গভীরতা ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০ কিলোমিটার এবং এর উৎপত্তি টঙ্গী থেকে ৩৩ কিলোমিটার উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে এবং নরসিংদীর ৩ কিলোমিটার উত্তরে। যার মাত্রা ছিল ৪.১।
এদিকে, রাজধানী ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, লক্ষীপুর, গোপালগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলায় সাত সকালে হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে মানুষের ঘুম ভেঙে গেছে মন্তব্য করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নেটিজেনরা ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার কথা জানান।
এর আগে, গত ২১ নভেম্বর (শুক্রবার) বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের একটা বড় অংশে প্রবল ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর পর থেকে বেশ কয়েক দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এতে বিরতি দিয়ে নরসিংদীতে ভূমিকম্প হচ্ছে। এতে কাঁপছে ঢাকাও। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ এসব ভূমিকম্পকে বড় কম্পনের পূর্বাভাস বলে সন্দেহ করছেন। এজন্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির তাগিদ দিচ্ছেন তারা। দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
তবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভূমিকম্প নতুন মনে হলেও এমন একটি দেশ রয়েছে যেখানে ভূমিকম্প প্রায় নিত্যদিনের ব্যাপার। দেশটি বাংলাদেশের পূর্বদিকের একটু দূরবর্তী প্রতিবেশী জাপান। বাংলাদেশের এই ভূমিকম্প-ভীতির প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশান্ত মহাসাগরের ‘রিং অব ফায়ারে’ অবস্থিত জাপান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বাংলাদেশের। যেখানে বছরে প্রায় দেড় হাজারের মতো ভূমিকম্প হয়।
নিয়মিত ভূমিকম্পের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও জাপান কীভাবে স্থিতিশীল আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণ করছে এবং এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, তা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে। বাংলাদেশের ভূতত্ত্ববিদ ও ভূমিকম্প বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সৈয়দ হুমায়ূন আখতার মনে করেন, জাপানের নাগরিকরা সচেতনতা ও প্রস্তুতির কারণেই ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হন না।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় নিয়ে যতটুকু প্রস্তুতি থাকে, ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ততটুকুও নেই। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের করণীয় নির্ধারণে জাপানের প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করা জরুরি।
বাংলাদেশি স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, জাপানে একটি শিশু জন্মের পর থেকেই ভূমিকম্পের বিষয়ে শেখা শুরু হয়। নিয়মিত মহড়ার মধ্য দিয়ে তারা জানে তাৎক্ষণিক কী করতে হবে। স্কুলগুলোতে শিশুরা ডেস্কের নিচে আশ্রয় নেওয়া এবং ভূমিকম্পের পরপর নিরাপদ আশ্রয়ের স্থান (যেমন পার্ক বা খেলার মাঠ) কোথায় হবে, সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ূন আখতার মনে করেন, নিয়মিত মহড়া করতে বিশেষ অর্থের প্রয়োজন নেই এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য জায়গায় এটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা যেতে পারে।
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার ও সহযোগী অধ্যাপক জুন সাতো বলেন, জাপানে সব ভবন, ছোট বা অস্থায়ী হলেও, ভূমিকম্প-সহনশীল হতে হয়। বড় শহরের উঁচু ভবনগুলো এমনভাবে নকশা করা হয়েছে, যাতে ভূমিকম্পের সময় সেগুলো কাঁপে না, বরং দুলতে থাকে।
এই প্রক্রিয়ায় ভবনগুলোকে সিসমিক আইসোলেশন নামে এক ধরনের বেয়ারিং বা শক অ্যাবজরবার (আঘাত সহনীয় বস্তু) এর ওপর বসানো হয়। কখনো কখনো ৩০ থেকে ৫০ সেমি পুরু রাবারের ব্লক ব্যবহার করা হয়।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ জিগি লুবকোভস্কি বলেন, মোশন ড্যাম্পারগুলো (যা সাইকেলের পাম্পের মতো দেখতে তবে ভেতরে তরল থাকে) ব্যবহার করে উঁচু ভবনের অতিরিক্ত নড়াচড়া অনেক কমিয়ে আনা যায়, ফলে কাঠামোর ক্ষতি রোধ হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির চেয়ে বর্তমানে প্রস্তুতিমূলক মহড়া ও সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া উচিত। একই সাথে, স্থপতি ইকবাল হাবিবের মতে, অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনগুলোর ক্ষেত্রেও যেন বিল্ডিং কোড মানা হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে অবকাঠামোগত নিরাপত্তা কার্যকর করা এবং একটি রেজিলিয়েন্স প্ল্যান বা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা তৈরি করা বাংলাদেশের জন্য সময়ের দাবি।
দৈনিক পুনরুত্থান / পুনরুত্থান নিউজ
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন
আপনার মতামত লিখুন: