৬ গুণ বেশি সময় ও ৪ গুণ অতিরিক্ত খরচ করেও শেষ হয়নি বিআরটি প্রকল্প
বিশ্বের যেকোনো বিআরটি প্রকল্পের চেয়ে ৬ গুণ বেশি সময় নিয়ে এবং ৪ গুণ অতিরিক্ত খরচ করেও অদ্যাবধি শেষ হয়নি গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর সড়কে বাস্তবায়নাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ।
এ প্রকল্পের ‘করিডর সিলেকশন ভুল ছিল’-এমন মূল্যায়নে পৌঁছেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টরা। আর এ ভুলের জন্য গচ্চা দিতে হচ্ছে তিন হাজার কোটি টাকা। যা ইতোমধ্যেই খরচ হয়েছে।
এমন অবস্থায় এ প্রকল্প বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন এটি বিশেষায়িত বাস লেনের পরিবর্তে সাধারণ চার লেন সড়ক হিসাবে ব্যবহৃত হবে। এ ব্যাপারে সামগ্রিক মূল্যায়নের জন্য একটি কারিগরি কমিটি করা হচ্ছে। একজন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞকে প্রধান করে শিগগিরই এই কমিটি গঠনসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হবে।
বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা জানান, গাজীপুর-বিমানবন্দর রুটে ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার বিআরটি প্রকল্প বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। বিআরটি প্রশস্ত সমতল সড়কে করা হলেও এই করিডরের কয়েক জায়গায় অকারণে ফ্লাইওভার তৈরি করে খরচ বাড়ানো হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ উইংয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, গাজীপুর-বিমানবন্দর করিডরের বিআরটি করার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে বিভিন্ন মূল্যায়নে উঠে এসেছে। এসব বিবেচনায় সরকার ওই করিডরটি সাধারণ পরিবহণ চলাচলের উপযোগী রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে বিশেষায়িত বাস চলাচল করবে না।
জানতে চাইলে সড়ক পরিবহণ, সেতু এবং রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. শেখ মইনউদ্দিন জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গাজীপুর-বিমানবন্দর বিআরটি প্রকল্প নিয়ে আর এগোবে না। এটি সাধারণ চার লেনের সড়ক হিসাবে ব্যবহার করা হবে। বিআরটি প্রকল্প নিয়ে নানা কথা রয়েছে। সেসব মূল্যায়ন করে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ের অর্থ থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। আর কোনো টাকা এ প্রকল্পে খরচ করবে না। প্রকল্পটি এখানেই শেষ করে দেওয়া হবে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুর-বিমানবন্দর করিডরটি সরু হওয়ায় এটি বিআরটির জন্য উপযুক্ত ছিল না। যথাযথ কারিগরি মূল্যায়ন না করে সরকার গায়ের জোরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন কাজ শুরু করে। এতে যা হবার তাই হয়েছে। ওই রুটে দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
অপর্যাপ্ত প্রশ্বস্ত সড়কে বিআরটির জন্য বিশেষায়িত লেন রাখলে যানজট বাড়বে, শিল্পাঞ্চলটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে-বিশেষজ্ঞ পর্যায় থেকে বারবার এমন পরামর্শ দেওয়া হলেও তা আমলে না নিয়ে এগিয়েছে সরকার। বাস কিনতে কয়েক দফা বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে। যদিও শেষমেশ তা আলোর মুখ দেখেনি।
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রকল্পের মূল ঘটনা বুঝতে পেরে বাস ক্রয় থেকে সরে এসে গাজীপুর-বিমানবন্দর করিডর উন্নয়ন করে প্রকল্প শেষ করার ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি কারিগরি মূল্যায়ন করে সার্বিকতা যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিশ্বের প্রায় ২০০টি শহরে বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটা খুব সহজ ও কম খরচের প্রকল্প। ভুল করিডর বেছে নেওয়ায় বাংলাদেশের বিআরটি কনসেপ্টটি মানুষের কাছে বড় জটিল হিসাবে প্রকাশ পেয়েছে।
অন্যসব পরিবহণ সচল রেখে বিআরটি হয় না, তবুও সেই চিন্তায় করিডর বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য শহরে বিআরটি প্রকল্প নির্মাণে সময় ৯ মাস থেকে ১৫ মাস পর্যন্ত লাগে। তবে বেশি দৈর্ঘ্যরে কয়েকটি বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে দুই থেকে আড়াই বছর পর্যন্ত সময় লেগেছে; সেগুলো দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার বা তার চেয়েও বেশি দৈর্ঘ্যরে।
আর গাজীপুর-বিমানবন্দর করিডরের বিআরটি প্রকল্পে সময় গেছে এক যুগেরও বেশি। ২০১২ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি এখনো চলছে। ব্যয়েও একই অবস্থা-বিশ্বে বিআরটি প্রকল্প ৫০০ থেকে এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের অহরহ রেকর্ড রয়েছে। তবে ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বিআরটি প্রকল্পের খরচ কিছুটা বেশি। তাও এই প্রকল্পের চেয়ে কম। তিন দফা প্রকল্পের ব্যয় সংশোধনের পর দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। জমি অধিগ্রহণ এবং করিডরের অবকাঠামোগত উন্নয়নে খরচ হয়েছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।
তবে যাদের ভুলের কারণে সরকারের বিপুল অঙ্কের অর্থ অপচয় হয়েছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে-এমন পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, শুধু অর্থ অপচয় নয়, প্রায় একযুগ ধরে সৃষ্ট তীব্র যানজটে সাধারণ মানুষের চরম দুর্ভোগ ও কর্মঘণ্টাও নষ্ট হয়েছে। উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে এই রুটের দুই পাশের শিল্প-কারখানার। পাশাপাশি অনিরাপদ নির্মাণ কাজের জন্য প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। সব মিলিয়ে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম অনেকটাই কমে আসবে। অন্যথায় এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
দৈনিক পুনরুত্থান /
- বিষয়:
- বিআরটি প্রকল্প
- বিআরটি
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন
আপনার মতামত লিখুন: