যেখানেই যাই এখন শুনতে হয় রেট আগের চেয়ে বেশি : জামায়াত আমির

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর শহীদের রক্ত ও পঙ্গু ভাই-বোনদের প্রতি সবার সম্মান দেখানো উচিত ছিল। কিন্তু কোনো কোনো দল সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে নিজেদের কর্মীদের সামাল দিতে। এই জন্য যেখানেই যাই এখন শুনতে হয় রেট আগের চেয়ে বেশি। কেন রেট আগের চেয়ে বেশি হবে? রেটই তো থাকবে না।


সর্বত্রই কথা শুনতে হচ্ছে, কেন এমনটি শোনা যায়?
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দুই দিনব্যাপী জেলা ও মহানগরী আমির সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। শনিবার ৩ মে সকাল ৯টায় মগবাজারস্থ আল-ফালাহ মিলনায়তনে এ সম্মেলন শুরু হয়। ডা. শফিকুর রহমান বলেন, চিহ্নিত অপরাধীদের ধরে পুলিশ থানায় নেওয়ার আগেই তদবির থানায় চলে আসে। এই ধারা বন্ধ করতে হবে।
স্বয়ং জামায়াতে ইসলামীর লোকেরাও যদি এটা করে মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে ঘৃণা করবে। এ কাজ যারাই করবে তাদেরকে মানুষ ঘৃণা করবে। তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালার অশেষ মেহেরবানিতে গত বছরের আগস্ট মাসের ৫ তারিখ ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। আপনারা সাক্ষী প্রথম তিন দিন কার্যত কোনো সরকার ছিল না। এ রকম পরিবর্তন যেসব দেশে সংঘটিত হয়েছে সেখানে ব্যাপক জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরা পারিপার্শ্বিক এ ঘটনাবলি থেকে শিক্ষা নিয়েছি এবং খুবই অনুভব করছিলাম জাতিকে শান্তি-শৃঙ্খলা ও ধৈর্য ধরার আহ্বান করা প্রয়োজন। আমরা ৫ আগস্ট রাতেই সে কাজটা করেছিলাম।
তিনি আরো বলেন, এ পরিবর্তনের পর আমাদের প্রথম কাজ ছিল শহীদ পরিবারের কাছে যাওয়া এবং পাশে দাঁড়ানো। দল হিসেবে নিশ্চই আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে।
তার পরও মানবিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমরা চেষ্টা করেছি শহীদ পরিবারের কাছে যাওয়ার। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার এবং একটা সংগঠন হিসেবে যতটুকু সম্ভব সেই সাপোর্টটুকু তাদের দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাদের সাপোর্টও তারা অনুগ্রহ করে গ্রহণ করেছে। এরপর আমাদের অগ্রাধিকার ছিলো যারা আহত এবং পঙ্গু হয়েছেন তাদের দিকে নজর দেওয়া।
জামায়াত আমির বলেন, দেশে যদি অস্থিরতা বিরাজ করে, যদি দেশের অর্থনীতি মুখ থুবরে পড়ে তাহলে আমরা সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হবো। এজন্য এখানে নাগরিক হিসেবে আমাদের সকলের দায় রয়েছে। তবে পরিবর্তনকামী একটি গঠনমূলক দল হিসেবে জামায়াতের দায় অনেক বেশী। এজন্য আমরা সমসময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার চেষ্টা করি।
তিনি বলেন, সাড়ে ১৫ বছর ধরে যারা হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, খুন, লুণ্ঠন ও অপহরণ করেছেন, জনগণের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছেন তাদেরও আমরা ন্যায্য বিচার দাবি করি। তারা যেন কোনোভাবেই কোনো ফাঁকফোকরে পার পেতে না পারে। আইনের আওতায় এনে তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ দাবি আমরা করে আসছি এবং এ দাবি আমরা করতেই থাকবো। এ বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের দাবি থাকবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা এরপরে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছিলাম, এ সরকার গঠিত হয়েছে জনআকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে। তাদেরকে ন্যায়সঙ্গত কাজে সহযোগিতা করা। তাদের জনস্বার্থবিরোধী কোনো কাজ আমাদের সামনে ধরা পড়লে আমরা সহযোগিতা করব না, আমরা পরামর্শ দিবো, প্রতিবাদ করব এবং ক্ষেত্র বিশেষে আবার প্রতিরোধ করব।


নির্বাচন অবশ্যই সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হতে হবে জানিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, এই সুষ্ঠু এবং বস্তুনিষ্ঠতার স্বার্থে কতিপয় সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। এ বিষয় আমরা আমাদের সুপারিশমালা সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলোর কাছে পেশ করছি। আমরা সকল দলের প্রতি আহ্বান জানাবো রাজনীতি নিজের জন্য নয়। রাজনীতি দেশ এবং জনগণের জন্য। আমরা যত বেশী সহযোগিতা করব ততো বেশী জাতি উপকৃত হবে। ততোটাই আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু এবং সুন্দর হবে। ইতোমধ্যে আমরা বলেছি যে, অবশ্যই যারা অপরাধী তাদের বিচারটা দৃশ্যমান হোক জাতি এটা দেখতে চায়। এ স্বল্প সময় সব বিচার করা সম্ভব নয় এটা আমরাও বুঝি। কিছু বিচারতো করতে হবে। যাতে জাতির মনে আস্থা তৈরী হয়। যারা প্রধান অপরাধী তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে দৃশ্যমান বিচার জাতির সামনে অবশ্যই উপস্থাপন করতে হবে। আমরা সরকারের একটা দুর্বলতা লক্ষ্য করি, বিচারের ক্ষেত্রে আমরা আরো গতি চাই। সরকার বেশী তৎপর হয়ে এই কাজটা করবে, এটা আমরা দেখতে চাই। যদি এদের বিচার হয় তাহলে আগামী নির্বাচনেও কালো টাকা এবং পেশী শক্তির প্রভাব খাটাতে পারবে না। আর এ রকমের দুঃসাহস হয়তো কেউ দেখাবে না। কিন্তু বিচার যদি না হয় এর আশঙ্কা তো থেকেই যাবে। আমরা এই নির্বাচনকে অর্থবহ করার জন্য এবং জনমতের শতভাগ প্রতিফলন ঘটানোর জন্য আমাদের দেশের পার্লামেন্টকে কোয়ালিটিসম্পন্ন পার্লামেন্ট দেখতে চাই। এজন্য নির্বাচনকে পেশীশক্তি এবং কালো টাকার প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে।
তিনি বলেন, আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থায় নির্বাচন হতে হবে। বিশ্বের ৬২টি দেশ এটা অনুসরণ করে। বেশীর ভাগ দেশ হচ্ছে উন্নত দেশ বলে যারা পরিচিত তারা সুফল পেয়েছে। এটা যারা একবার শুরু করেছে তারা আর বাদ দেয়নি। আমরা ট্র্যাডিশনাল নির্বাচন পদ্ধতি দেখেছি। তার ভিতরে সংসদের মধ্যে আইন প্রণেতা হিসেবে মনোনীত ব্যক্তিরা লেখা দেখে যারা পড়তে পারেন না তারাও সংসদ সদস্য হয়েছেন। তারা কী আইন রচনা করে বাংলাদেশের মানুষকে দিবেন? তারা কোন আইনটা সংস্কার সাধন করার মতো যোগ্যতা রাখেন? এজন্য আমরা বলেছি যে, আনুপাতিক হারে সেখানে যাবে। যে যতো পার্সেন্ট ভোট পাবে সে ততো আসন পাবে। এতে করে কোনো দলকে ছোট এবং বড় বলার কারো সাহস হবে না। দল ছোট হউক বড় হউক দল দলই এবং কোনো দল কারো দয়ার পাত্র হবে না। তার নিজের দল নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অতিসম্প্রতি নারী বিষয়ক সংস্কার কমিটি প্রধান উপদেষ্টা বরাবর সুপারিশমালা সাবমিট করেছে। আমরা বিস্মিত, আমাদের বিদ্যমান কালচার তমদ্দুনের সম্পূর্ণ বিপক্ষে। তারা কিছু সুপারিশমালা এনেছেন এগুলো বিবেচনা করার প্রশ্নই আসে না। শুধু তাই নয় তাদের কিছু কিছু সুপারিশ আল্লাহর বিধানের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে পেশ করা হয়েছে। তাদের এই সুপারিশ গ্রহণ করলে কুরআন পরিবর্তন হয়ে যাবে। অথচ আল্লাহ তায়ালা কুরআন নাযিল করে বলেছেন, কুরআন নাযিল করেছি আমি, রক্ষাও করবো আমি। এখানে একটা হরফ, নুকতাও কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না।
নির্বাচন প্রসঙ্গে আমিরে জামায়াত বলেন, প্রধান উপদেষ্টা এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী ২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছেন। ফেব্রুয়ারির শেষে এবং মার্চের তিন ভাগের দুই ভাগ সময় জুড়ে রোযা থাকবে, তার পরেই ঈদ। এই সময় কোনো নির্বাচনের সময় নয়। দু’টি সময় আমরা নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত মনে করি। একটি হচ্ছে ফেব্রুয়ারি মাস রোযা শুরুর আগে। আরেকটা হচ্ছে যদি কোনো কারণে এই সময়ের ভিতরে সংস্কারগুলো এবং বিচারের দৃশ্যমান প্রক্রিয়া জনমনে আস্থা সৃষ্টির পর্যায়ে না আসে তাহলে ম্যাক্সিমাম এপ্রিল পার হওয়া উচিত নয়।
তিনি বলেন, বিশেষ করে আমরা দেখতে পাচ্ছি গাজায় ফিলিস্তিনের উপর বছরের পর বছর জুলুম করা হচ্ছে। আমরা চাই এটার অবসান হোক। পার্শ্ববর্তী দেশসহ যেখানে ছুতোনাতায় বিশেষ করে ধর্মীয় আবেগকে উস্কে দিয়ে জুলুম করা হয়। এটা বন্ধ করা হোক।


দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে তিনি বলেন, আমরা একটা মজলুম দল। যুগে যুগে আমাদের উপর বিভিন্ন পক্ষ জুলুম করেছে। আমরা কোনো প্রতিশোধ নিতে চাই না। তবে আমরা যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, নিহত হয়েছি, আহত হয়েছি, গুমের শিকার হয়েছি অন্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, সেই জায়গাগুলোতে অবশ্যই আমরা আইনের মাধ্যমে প্রতিকার চাওয়ার অধিকার রাখি এবং আমরা চাইব।
অর্থ পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছরসহ স্বাধীনতার পর থেকে যারা দেশের সম্পদ চুরি করে বিদেশে পাঁচার করেছেন, এদের সকলের অপকর্মের শ্বেতপত্র জাতির সামনে প্রকাশ করতে হবে এবং পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি এগুলোর সাথে রাজনীতির কালো হাত ছিল, না হলে এত বড় অপরাধ তারা করতে পারতো না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে গত সাড়ে ১৫ বছরে ২৬ লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আমরা চাই পাঁচারকৃত সকল টাকা ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা দেওয়া হবে এবং জনকল্যাণে সেটা ব্যয় হবে।
সম্মেলন পরিচালনা করেন সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম, মাওলানা মো. শাহজাহান, অ্যাড. মুয়াযযম হোসাইন হেলাল, অ্যাড. এহসানুল মাহবুব জুবায়েরসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী ও কর্মপরিষদ সদস্য, জেলা ও মহানগরী আমিরবৃন্দ।
আমিরে জামায়াত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ২০১১ সালের এপ্রিল মাসের পর দীর্ঘ ১৪ বছরে এ ধরনের প্রোগ্রাম করার সুযোগ পাইনি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের আবার এই সুযোগ করে দিয়েছেন। এজন্য মহান মনিবের দরবারে লাখো শুকরিয়া আদায় করি আলহামদুলিল্লাহ। ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং তাদের সঙ্গীরা বাংলাদেশকে শাসন এবং শোষণ করেছেন। পুরো সময় জুড়ে তারা এই দেশের বিরোধী দল, মত এবং বিশেষভাবে ইসলামপন্থী জনগণের উপর বিভিন্ন পর্যায় তাণ্ডব চালিয়েছে। কমপক্ষে তিনটি গণহত্যা সংঘটিত করেছে। প্রথম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তৎকালীন বিডিআর হেডকোয়াটার পিলখানায়। যেখানে আমরা হারিয়েছি ৫৭ জন চৌকস দেশপ্রেমিক প্রতিশ্রুতিশীল সামরিক অফিসার। এর পরে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে, হেফাজতের আহ্বানে যে সমাবেশ হয়েছিলো সেই সমাবেশে রাতের বেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে গোটা অন্ধকারে নির্বিচারে মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়েছে। আর তৃতীয় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে গত বছরের জুলাই মাসের মধ্য দিনগুলো থেকে আগস্ট মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত। ফ্যাসিবাদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতা সহকর্মী, বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী এবং আলেম-উলামা।


দৈনিক পুনরুত্থান /
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আপনার মতামত লিখুন: