দুঃসাহসী আত্মত্যাগ: ব্যক্তিজীবনে যেমন ছিলেন মাহেরীন-মাসুকা

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোনে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিষ্পাপ শিশুদের জীবন বাঁচিয়ে সবার মাথার তাজ হয়ে উঠেছেন দুই শিক্ষক-মাহেরীন চৌধুরী ও মাসুকা বেগম। তারা জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে আটকে পড়া শিশুদের একের পর এক তুলে আনেন পরম মমতায়। নিষ্পাপ ফুলগুলো বাঁচানোর তাগিদে মৃত্যুকে দুহাতে আলিঙ্গন করেন তারা। এই দুই মহান শিক্ষকের কাছে জাতি ঋণী হয়ে গেল। মহৎ হৃদয়ের অধিকারী না হলে পরের তরে জীবন উৎসর্গ করা যায়!


সোমবার বিমান বিধ্বস্তের পর মৃত্যুমিছিলের শোক ছাপিয়ে দুই শিক্ষকের বীরত্বগাথা ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ইন্টারনেট দুনিয়ায় ভাসতে থাকে তাদের ছবি। দুই মহৎপ্রাণ নিয়ে চর্চা শুরু হয় বিশ্বজুড়ে। বিশেষ করে মাহেরীনের আত্মত্যাগের প্রশংসা করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। অবশেষে তাদের এই মহৎ আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসে রাষ্ট্র। ইতোমধ্যে তাদেরকে জাতীয় বীর হিসাবে ঘোষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের এক বৈঠক শেষে সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে অন্তত ২০ শিশুর জীবন রক্ষা করেন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির সমন্বয়ক মাহেরীন চৌধুরী।আগুনে তার শরীরের বেশির ভাগ অংশ পুড়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে হাসপাতালের বেডে স্বামী মনসুর হেলালকে কাছে পান মাহেরীন। সেখানেই স্বামীর সঙ্গে তার শেষবারের মতো সাক্ষাৎ হয়।
স্ত্রীর সঙ্গে শেষ কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মনসুর হেলাল সাংবাদিকদের বলেন, লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে সে বলল ‘আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরো।’ কিন্তু হাত ধরার উপায় ছিল না। পুড়ে ক্ষতবিক্ষত। সে শুধু ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না।’ আমি কাঁদছিলাম। বললাম, তোমারও তো দুটো শিশু সন্তান আছে। তাদের এতিম করে গেলা? একবারও ভাবলে না? মাহেরীনের জবাব-কী করব বলো। ওরাও তো আমার সন্তান। সবাই পুড়ে মারা যাচ্ছে। আমি যে ওদের রক্ষা করার শপথ নিয়েছিলাম। বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে দাঁড়িয়ে মনসুর হেলাল যখন এসব কথা বলেন, তখন সেখানে পীনপতন নীরবতা। অপেক্ষমাণ গণমাধ্যমকর্মীদের চোখ ভিজে ওঠে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তৃতীয় শ্রেণির একটি কক্ষের নাম ‘স্কাই’। দুর্ঘটনাকবলিত বিমানটি সেখানেই আছড়ে পড়ে। তখন কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় চারপাশ। মুহূর্তে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুনের লেলিহান শিখা। শিক্ষার্থীদের অনেকে ভেতরে আটকা পড়ে। বাঁচাও বাঁচাও বলে তাদের আর্তনাদ। পরিস্থিতি বিভীষিকাময়। যে যার মতো পালাচ্ছে। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু মাহেরীন। অগ্নিশিখা ভেদ করে এগিয়ে যান তিনি। একের পর এক শিশুদের বের করে আনতে থাকেন। অন্তত ২০টি শিশুকে নিরাপদে বের করে আনতে সক্ষম হন তিনি। এ সময় অগ্নিকুণ্ডে দ্বিতীয়বার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে মাহেরীনের শরীরে আগুন ধরে যায়। তিনি মেঝেতে পড়ে যান। পরে অর্ধপোড়া অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে জীবনের আশা ক্ষীণ হয়ে গেছে। নিভতে চলেছে জীবনপ্রদীপ। বার্ন ইনস্টিটিউটের লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় সোমবার রাতে ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীকে বিদায় জানান মাহেরীন। হাস্যোজ্জ্বল মুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন তিনি।
স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১৭ বছরেরও বেশি সময় কর্মরত ছিলেন মাহেরীন। সহকারী শিক্ষক থেকে ধাপে ধাপে তিনি সমন্বয়ক হিসাবে পদোন্নতি পান। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদের কাছেও তিনি সমান জনপ্রিয় ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি নীলফামারী। মঙ্গলবার গ্রামের বাড়িতে মা-বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয় তার লাশ।


শিক্ষার্থীরাই মাসুকার সন্তান
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বিয়ে করেননি মাসুকা বেগম। স্কুলই ছিল তার বাড়ি। শিক্ষার্থীরা ছিল আপন সন্তানতুল্য। সোমবার দুপুরে দুর্ঘটনাকবলিত যুদ্ধবিমান যখন স্কুলের ওপর আছড়ে পড়ে, তখনো তিনি ক্লাসে। ইংরেজি পড়াচ্ছিলেন। চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পেয়ে শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘তোমরা ভয় পেও না। আমি আছি।’ এরপর তিনি একে একে শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে থাকেন। একপর্যায়ে মাসুকা নিজেও আগুনে গুরুতর দগ্ধ হন। তার শরীরের ৮৫ শতাংশের বেশি পুড়ে যায়। পরে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হলে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই বীর শিক্ষক।
মাসুকার বাবা সিদ্দিক আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, মাসুকা ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিল। ১৫ বছর আগে তার মা মারা যায়। শিক্ষকতা করেই সে আমাদের সবার দেখভাল করত। প্রতিমাসেই নিয়ম করে টাকা পাঠাত। সংসারের অন্যদের কথা ভেবে সে আর বিয়ে করতে চায়নি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, মেয়ের সঙ্গে তার শেষ কথা হয় ১০-১৫ দিন আগে। তখন বুঝতে পারিনি তার সঙ্গে আমার এটাই হবে শেষ কথা।
মাসুকার বোনের স্বামী খলিলুর রহমান বলেন, সোমবার বিমান দুর্ঘটনার পর থেকেই মাসুকার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তার মোবাইল ফোনে বারবার কল করা হলেও কেউ ফোন ধরছিল না। ঘণ্টাখানেক পর একজন ফোন ধরে। সে শুধু বলে মাসুকা আগুনে আহত হয়েছে। এরপর লাইন কেটে যায়। পরে তাকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাওয়া যায়। চিকিৎসকরা আগেই বলেছিলেন তার কণ্ঠনালিসহ শরীরের ৮৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। বাঁচার সম্ভাবনা কম। সোমবার রাত সাড়ে ১২টায় আমাদেরকে তার মৃত্যুর খবর জানানো হয়।
পরিবারের সদস্যরা জানান, শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মাসুকার লাশ মঙ্গলবার তার বড় বোনের শ্বশুরবাড়ি আশুগঞ্জের সোহাগপুরে নেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৬টায় সেখানেই তার লাশ দাফন করা হয়। তাকে শেষবার একনজর দেখতে স্বজনরা জড়ো হন। এ সময় গ্রামজুড়ে এক শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়।


দুর্ঘটনার সময় বীরোচিত ভূমিকার স্বীকৃতি দিতে এ দুই শিক্ষককে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব সুচিস্মিতা তিথি।
দৈনিক পুনরুত্থান /
- বিষয়:
- দুঃসাহসী আত্মত্যাগ,মাহেরীন
- মাসুকা
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

আপনার মতামত লিখুন: